জিনাত মলি’র নিবন্ধ: র‍্যাগিং একটি ব্যাধি নয় আতংকের নাম

by protibimbo
০ মন্তব্য ৮৮ বার পড়া হয়েছে

র‍্যাগিং একটি ব্যাধি নয় আতংকের নাম
জিনাত মলি

কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন পরিবেশ, নতুন মুখ, নতুন স্বপ্ন—এর মাঝেই কিছু শিক্ষার্থী এমন এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় যা তাদের মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। নামটা অনেকের পরিচিত—“র‍্যাগিং”।
শুনতে যেন মজার একটা রীতি, কিন্তু বাস্তবে এটি এক ধরণের মানসিক ও সামাজিক সহিংসতা, যা নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাস কেড়ে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

র‍্যাগিং কী?
র‍্যাগিং হলো সিনিয়র শিক্ষার্থীদের দ্বারা জুনিয়রদের ওপর জোরপূর্বক আচরণ, অপমান, মানসিক বা শারীরিক হয়রানি।
কখনো গান গাওয়ানো, নাচ করানো, বাজে প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য করা—আবার কখনো মারধর, হুমকি বা যৌন হয়রানির পর্যায় পর্যন্ত যায় এই র‍্যাগিং।
বাংলাদেশ, ভারত, নেপালসহ বহু দেশেই এখন র‍্যাগিংকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

এটা কি মানসিক রোগ?
অনেকে বলেন—র‍্যাগিং করা মানেই পাগলামি, মানসিক রোগ। আসলে তা নয়। র‍্যাগিং কোনো চিকিৎসাবিজ্ঞানে সংজ্ঞায়িত মানসিক রোগ নয়,
বরং এটি এক ধরনের অসুস্থ সামাজিক মানসিকতা ও বিকারগ্রস্ত আচরণ। যে ব্যক্তি র‍্যাগিং করে, তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকতে পারে—
ক্ষমতা প্রদর্শনের ইচ্ছা, অন্যকে ছোট করার আনন্দ, অথবা “আমাকেও একসময় র‍্যাগিং করা হয়েছিল, তাই আমিও করব” — এই প্রতিশোধের মানসিকতা।
এই মানসিকতা একধরনের সামাজিক বিকৃতি, যা সহানুভূতির ঘাটতি ও মানবিকতার অভাব থেকে জন্ম নেয়। অন্যদিকে, র‍্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীরা পড়ে যায় গভীর মানসিক সংকটে; উদ্বেগ, ডিপ্রেশন, আত্মবিশ্বাসের অভাব, এমনকি আত্মহত্যার চিন্তায়ও ভুগে অনেকে। তাই বলা যায়, র‍্যাগিং মানসিক রোগ নয়, কিন্তু এটি মানসিক রোগের জন্ম দেয়।

banner

কেন র‍্যাগিং হয়?
র‍্যাগিংয়ের শিকড় আমাদের সামাজিক মানসিকতার গভীরে প্রোথিত। “সিনিয়র মানেই কর্তৃত্ব”—এই ধারণা ছোটবেলা থেকেই শেখানো হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনো “র‍্যাগিং ট্র্যাডিশন” হিসেবে দেখা হয়। প্রশাসনিক নজরদারি না থাকা, দুর্বল আইনি ব্যবস্থা, আর সামাজিক উদাসীনতা এই সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
অনেক সময় ভুক্তভোগীরাই পরবর্তীতে অপরাধী হয়ে যায়—একটা অমানবিক চক্র তৈরি হয়, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ে।

র‍্যাগিংয়ের ভুক্তভোগীর মানসিক বাস্তবতা
একজন নতুন শিক্ষার্থী যখন আশা আর ভয়ের মিশ্র অনুভূতি নিয়ে কলেজে আসে, তখন র‍্যাগিংয়ের মতো অপমানজনক অভিজ্ঞতা তাকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়।
অনেকে পড়াশোনায় মনোযোগ হারায়, আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
কেউ কেউ এমনও মনে করে—“আমার আর বেঁচে থাকার মানে নেই।”
র‍্যাগিংয়ের ফলে অনেক তরুণ-তরুণী আজও ভয়, ট্রমা আর আত্মসম্মানের অভাবে ভুগছে।
এটা কেবল ব্যক্তি নয়—পুরো সমাজের মানবিকতা নষ্ট করছে নিঃশব্দে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা
র‍্যাগিং বন্ধের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য।
র‍্যাগিং বিরোধী সেল ও হটলাইন স্থাপন করা দরকার।
মনোবিজ্ঞানী ও কাউন্সেলর নিয়োগ জরুরি, যেন নতুন শিক্ষার্থীরা মানসিক সহায়তা পায়।
সিনিয়রদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে—নেতৃত্ব মানে আধিপত্য নয়, সহমর্মিতা।
শিক্ষকদের নিয়মিত মনিটরিং ও আলোচনা সভার আয়োজন করতে হবে।

সমাজ ও পরিবারের দায়িত্ব
পরিবার ও সমাজকেও বুঝতে হবে—র‍্যাগিং কোনো রসিকতা নয়। এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মানসিক বিকাশের পথে বড় বাধা। অভিভাবক ও নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব; সন্তানদের সহানুভূতিশীল হতে শেখানো, অন্যকে সম্মান করা, এবং কোনো ধরনের হয়রানি সহ্য না করা।

পরিশেষে র‍্যাগিং মানসিক রোগ নয়, তবে এটি এক রোগগ্রস্ত সমাজব্যবস্থার উপসর্গ।
আমরা যদি সত্যিই শিক্ষিত সমাজ গড়তে চাই, তবে দরকার ভয় নয়, বন্ধুত্বের পরিবেশ।
যেখানে সিনিয়র–জুনিয়র সম্পর্ক হবে ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সহযোগিতার ভিত্তিতে।
একটি নিরাপদ, মানবিক ও সচেতন শিক্ষা সংস্কৃতি গড়ে তোলাই হবে
র‍্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরোধ।
______________________
লেখক: জিনাত জাকিয়া তুর রায়হান ওরফে জিনাত মলি
(সামাজিক কর্মী, নারী উদ্যোক্তা ও শিক্ষাবিদ)

সম্পর্কিত খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আবুল খায়ের 

নির্বাহী সম্পাদক: 
বার্তা প্রধান:

অফিস: বাড়ি ০৭, সড়ক ১৪/সি, সেক্টর ৪,

উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।

যোগাযোগ: ০১৭১৫৩৬৩০৭৯

বিজ্ঞাপন: ০১৮২৬৩৯৫৫৪৯

Email: khair.hrm@gmail.com

info@dainikprotibimbo.com

protibimboprokash.com

Facebook

©2025 Dainik Protibimbo – All Right Reserved. Designed and Developed by Bangla Webs