সাহিত্য আলোচনা : কবি মনিরুল ইসলাম-এর কবিতার বিশ্লেষণ: আবুল খায়ের

সাহিত্য

by protibimbo
০ মন্তব্য ১২৪ বার পড়া হয়েছে

কবি মনিরুল ইসলাম-এর “ভুল সবই ভুল” কবিতাটির একটি গভীর জ্ঞানভিত্তিক ভাষা ও সাহিত্য বিশ্লেষণ:

মূল কবিতা:
ভুল সবই ভুল
০৬/১২/২০১৭

তোমার দেয়া ফুল,
নেয়া ছিল মোর ভুল।

হয়ে সে ফুল বাসি আজি
রোদন হয়ে উঠেছে বাজি।

banner

যে মালা ধরেছিলাম গলে যতন করে
শুকিয়ে গেছে হায়-
ফুল গুলি আজ পড়ছে ঝরে।

সেতো সুতোয় গাঁথা ফুল,
জীবনে বাঁধা মোর ভুল।
একদিন জেগেছিল আশা, গেয়েছিল বুলবুল।
হেলে দুলে নেচেছিল মৌমাছি ছন্দে দোদুল।

আজ ফুল নাহি হাসে।
মৌমাছি ঘুরে যায় বাতাসে।
দিয়ে মোরে হুল…
ভুল ভুল ভুল, সবই ছিল মোর ভুল।

দেখে তোমার মালা গাঁথা,
ঘুচাতে মোর প্রাণ ব্যথা,
জেগেছিল লোভ সে মালা পড়তে গলে।

ভাবিনি কভু ও যে ছেড়া ফুল,
গন্ধহীনায় শুকোতে ব্যকুল,
বাড়িয়ে ব্যথা শুধু ঝরে ঝরে যাবে চলে।

প্রবন্ধ শিরোনাম:

“ভুলের মালায় গাঁথা স্মৃতি: মনিরুল ইসলামের কবিতায় প্রেম, প্রতারণা ও প্রজ্ঞা”

ভূমিকা
সমকালীন বাংলা কবিতার জগতে মনিরুল ইসলাম এক বিশিষ্ট নাম। তাঁর কবিতায় মানবমন, প্রেম-ভুল-বেদনার সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রকাশ লক্ষণীয়। “ভুল সবই ভুল” কবিতাটি এক গভীর আত্মোপলব্ধির আখ্যান, যেখানে প্রেমের স্মৃতি, প্রতারণার যন্ত্রণা এবং তার পরিণতির উপলব্ধি মিলেমিশে এক অনবদ্য কাব্যিক বয়ান নির্মাণ করেছে। কবিতাটি মূলত প্রেমে প্রতারিত এক হৃদয়ের বিষাদগাথা, যেখানে প্রতীক, উপমা ও চিত্রকল্পে ফুটে উঠেছে এক বিমূঢ় আত্মবেদনার ভাষা।

ভাষা ও শৈলী
কবিতাটির ভাষা সরল হলেও গভীরভাবে প্রতীকী। প্রতিটি পংক্তিতে কবি বেছে নিয়েছেন এমন চিত্র ও শব্দ, যা বহন করে একাধিক ব্যঞ্জনা। ফুল, মালা, মৌমাছি, বুলবুল প্রভৃতি চিরপরিচিত উপমা ও প্রতীক ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি মানব-সম্পর্কের জটিলতা ও বিভ্রমকে তুলে ধরেছেন। যেমন:

“তোমার দেয়া ফুল, নেওয়া ছিল মোর ভুল।”

এই পংক্তিতে “ফুল” শুধুমাত্র একটি বস্তু নয়, বরং প্রেম, উপহার এবং সম্পর্কের প্রতীক। সেই ফুলই এখন “বাসি” হয়ে গেছে, অর্থাৎ সম্পর্কের সৌন্দর্য ও সতেজতা আজ নিঃশেষ।

প্রতীক ও চিত্রকল্প
পুরো কবিতাটি জুড়ে কবি যে চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন তা একাধারে জীবন্ত এবং মর্মান্তিক। বিশেষ করে ‘মালার’ প্রতীকটি একদিকে প্রেমের বন্ধনের প্রকাশ, অন্যদিকে সেটি শুকিয়ে যাওয়া এবং ঝরে পড়ার মধ্য দিয়ে সম্পর্কের মৃত্যুঘোষণা। মালাটি “ছেঁড়া ফুল” দিয়ে গাঁথা—এখানে কবি বোঝাতে চেয়েছেন প্রেমটি ছিল ক্ষয়িষ্ণু, মিথ্যা সৌন্দর্যে মোড়া।

মৌমাছি ও বুলবুলের চিত্রকল্পও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ:

“হেলে দুলে নেচেছিল মৌমাছি
ছন্দে দোদুল।”

এই ছন্দময় মুহূর্তগুলি যেন প্রেমের প্রারম্ভিক পর্যায়ের মধুময় দিনগুলোর স্মারক। কিন্তু পরিণতি হলো ব্যথার, মৌমাছি কেবল এখন হুল ফোটায়:

“আজ ফুল নাহি হাসে,
শুধু মৌমাছি ঘুরে যায় বাতাসে
দিয়ে মোরে হুল।”

এই প্রতীকটি দ্ব্যর্থক—একদিকে প্রেমিকাকে বোঝায়, অন্যদিকে সেই সম্পর্কের ধারাবাহিক বিষের স্মৃতি। হুল ফোটানো এখানে প্রতারণার যন্ত্রণার স্পষ্ট রূপক।

নন্দনতত্ত্ব ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ
এই কবিতা প্রেমের ব্যর্থতা ও তার অন্তর্নিহিত শিক্ষার কাব্যিক রূপায়ণ। শেষাংশে কবি বুঝতে পারছেন যে মালা দেখে প্রেমে পড়া ছিল এক প্রলুব্ধিক আকর্ষণ, যার অন্তরালে ছিল প্রতারণা:

“ভাবিনি কভু, ও যে ছেঁড়া ফুল,
গন্ধহীনায় শুকোতে ব্যকুল…”

প্রেমিকাকে এখানে এক নিঃসত্ত্ব, সৌন্দর্যহীন, শুষ্ক অস্তিত্ব হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই উপলব্ধি এক দর্শনীয় স্তরে গিয়ে ঠেকেছে, যেখানে কবি কেবল প্রেমের ব্যর্থতা নয়, সেই ব্যর্থতা থেকে জন্ম নেয়া আত্মজ্ঞানকেও ছুঁতে পেরেছেন। “সবই ছিল মোর ভুল”—এই চূড়ান্ত স্বীকারোক্তি আত্মসমালোচনার চূড়ান্ত রূপ।

উপসংহার
“ভুল সবই ভুল” কেবল একটি প্রেমের কবিতা নয়, এটি প্রেমে পড়ে প্রতারিত হওয়া, তবুও সেই প্রতারণার গভীরে গিয়ে জীবনের এক নতুন উপলব্ধিতে পৌঁছানো এক অন্তরঙ্গ আত্মসংলাপ। মনিরুল ইসলামের কাব্যভাষা এখানে সরল অথচ বহুরৈখিক—যা কেবল হৃদয় ছুঁয়ে যায় না, মননেও রেখাপাত করে। প্রেম, স্মৃতি, ভুল এবং আত্মশুদ্ধির এই কাব্যিক চিত্রায়ন বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ অবস্থান দাবি করে।

লেখক: আবুল খায়ের (কবি ও কলামিস্ট)
সম্পাদক: কালের প্রতিবিম্ব

সম্পর্কিত খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আবুল খায়ের 

নির্বাহী সম্পাদক: 
বার্তা প্রধান:

অফিস: বাড়ি ০৭, সড়ক ১৪/সি, সেক্টর ৪,

উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।

যোগাযোগ: ০১৭১৫৩৬৩০৭৯

বিজ্ঞাপন: ০১৮২৬৩৯৫৫৪৯

Email: khair.hrm@gmail.com

info@dainikprotibimbo.com

protibimboprokash.com

Facebook

©2025 Dainik Protibimbo – All Right Reserved. Designed and Developed by Bangla Webs