৯৯
মুসলিম রেনেসাঁর কবি , আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি ফররুখ আহমদ। বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণা জোগাতে কার্যকরী ভূমিকা রাখায় তিনি মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত।
ফররুখ আহমদের জন্ম, শিক্ষা ও প্রাথমিক জীবন: ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাগুরা জেলার শ্রীরামপুর থানার মাঝাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ফররুখ আহমদ। ১৯২৪ সালে মা রওশন আখতারের মৃত্যু ঘটে। ১৯৩৭ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে রিপন কলেজে ভর্তি হন। স্কুল জীবনেই সম্পর্ক স্থাপিত হয় কবি গোলাম মোস্তফা, কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল এবং কবি আবুল হাশিমের সাথে। বিখ্যাত সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায় ছিলেন তার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের সহপাঠী। পরবর্তীতে আহসান হাবীব, আবু রুশদ ও আবুল হোসেনের সঙ্গে মিত্রতা হয় তার।
কর্মজীবন: স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শন ও ইংরেজী সাহিত্যে বিএ ভর্তি হলেও অসমাপ্ত রেখেই নেমে পড়তে হয় কর্মজীবনে। ১৯৪৩ সালে কলকাতা আই.জি. প্রিজন অফিসে যোগদান করেন। একবছর পরেই সেখান থেকে সরে গিয়ে যোগ দেন সিভিল সাপ্লাই অফিসে। ১৯৪৫ সাল থেকে মোহাম্মদী পত্রিকাতে কাজ শুরু করেন, এরপর ১৯৪৬ সালে জলপাইগুড়িতে একটি ফার্মে চাকুরী করেন। ১৯৪৮ সালে কোলকাতা থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। ঢাকা বেতারে নিয়মিত ষ্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন তিনি। ঢাকা বেতারে তিনি “ছোটদের খেলাঘর” অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। একবার বাংলাদেশ বেতার থেকেও তাঁর চাকরি চলে যায়। এ সময়ে এগিয়ে এলেন আরেক কিংবদন্তী সাহিত্যিক আহমদ ছফা। “ফররুখ আহমদের কী অপরাধ” শীর্ষক তীব্র ও তীক্ষ্ণ প্রতিবেদন লিখলেন গণকণ্ঠ পত্রিকায়। ফলে কবিকে পুনর্বহাল করা হয়। তবে শেষ জীবনে কবি অবমূল্যায়ন এবং ভয়াবহ অর্থসংকটে জীবন যাপন করেছেন।
ফররুখ আহমদের কাব্যপ্রতিভা ও মূল্যায়ন: কাব্যপ্রতিভায় ফররুখ আহমদ অনন্য সৃষ্টিশীল কবি ছিলেন। তিনি অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। কবি ফররুখ আহমদের কাব্যগ্রন্থগুলো হলো- ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৪), ‘সিরাজাম মুনিরা’ (১৯৫২), ‘নৌফেল ও হাতেম’ (১৯৬১), ‘মুহুর্তের কবিতা’ (১৯৬৩), ‘ধোলাই কাব্য’ (১৯৬৩), ‘হাতেম তায়ী’ (১৯৬৬), ‘নতুন লেখা’ (১৯৬৯), ‘কাফেলা’ (১৯৮০), ‘হাবিদা মরুর কাহিনী’ (১৯৮১), ‘সিন্দাবাদ’ (১৯৮৩), ‘দিলরুবা’ (১৯৮৪)।
শিশু সাহিত্যেও তিনি অতুলনীয় ছিলেন। তার রচিত শিশুতোষ গ্রন্থ হলো- ‘পাখির বাসা’ (১৯৬৫), ‘হরফের ছড়া’ (১৯৭০), ‘চাঁদের আসর’ (১৯৭০), ‘ছড়ার আসর’ (১৯৭০), ‘ফুলের জলসা’ (১৯৮৫)।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতায় আরবী, ফারসী শব্দের যে স্বার্থক প্রয়োগ শুরু করেন, মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ তা আরও বেগবান করেন।
১৯৪৩ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে ফররুখ আহমদ অসংখ্য কবিতা রচনা করেন।
দুর্ভিক্ষ নিয়ে অদ্যবধি বাংলা সাহিত্যে ‘লাশ’ এর মত কবিতা আর কেউ লিখতে পারেনি। দুর্ভিক্ষ নিয়ে ব্যাথিত কবির উচ্চারণ-“যেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে জমিনের পর; সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখেনা সে মৃতের খবর”।
মুসলিম কবিদের মধ্যে কাব্যনাটক রচনার পথিকৃত তিনি। তার ‘নৌফেল ও হাতেম’ একটি সফল ও জনপ্রিয় কাব্যনাটক।
সনেট রচনায়ও সফল তিনি। বাংলা সাহিত্যে মাইকেলের পরে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে আর কোন কবি এত বেশি সফল সনেট রচনা করতে পারেনি। তার সনেট গ্রন্থের মধ্যে- ‘মুহুর্তের কবিতা’, ‘দিলরুবা’, ‘অনুস্বার’ প্রধান।
গদ্য কবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত কবি ফররুখ আহমদ। তার গদ্য কবিতার সংকলন-‘হাবেদা মরুর কাহিনী’ লিখে সফল তিনি। গীতিনাট্য ‘আনার কলি’ (১৯৬৬)।
কবি ফররুখ আহমদের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সমাদৃত “সাত সাগরের মাঝি”- কাব্যগ্রন্থের ভাষা ও ভাষ্য, ব্যাকুলতা ও আবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কবি একই সঙ্গে মুসলিম সমাজকে অতীত ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে উজ্জীবিত করছেন আবার তাদের পতিত জীবনযাপন দেখে ব্যথিত হয়েছেন। তিনি তাদের সোনালি দিনের শোভা গ্রহণ করতে বলছেন, অতীতে ফিরে যেতে নিষেধ করছেন। আর অতীতে ফিরে না গিয়ে ঐতিহ্য ধারণের নামই সম্ভবত জাগরণ। এ ডাক দিয়ে যাওয়ায় ফররুখ আহমদ জাগরণের কবি।
বাংলা সাহিত্যে ‘হাতেম তায়ী’ কবি ফররুখ আহমদের লেখা প্রায় সোয়া তিন শত পৃষ্ঠায় সমাপ্ত এক বিরাট মহাকাব্য।
পুরস্কার ও সম্মাননা: কবি ফররুখ আহমদ কবি স্বীকৃতি স্বরুপ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। অন্যতম হলো- বাংলা একাডেমী (১৯৬০), প্রেসিডেন্ট পদক ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ (১৯৬৫), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬), একুশে পদক (১৯৭৭-মরনোত্তর), স্বাধীনতা পদক (১৯৮০-মরনোত্তর)
ফররুখ আহমদের ইন্তেকাল ও বেদনামাখা কিছু কথা: কবি ফররুখ আহমদ ১৯৭৪ সালের ১৯শে অক্টোবর ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তিনি তার কবিতায় সমাজের অবহেলিত মানুষের কথা লিখে গেলেও তার জীবনে তাকে বহু দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হতে হয়েছে। মূলত ইসলামী আদর্শ লালন করার কারনেই তাকে এত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে বলে মনে করা হয়। এমনকি ঢাকা বেতার থেকে তার চাকুরী চলে যায়।
তার এক ছেলে ডাক্তারি পড়ছিল, টাকার অভাবে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। চিকিৎসার অভাবে এক মেয়ে মারা যায়। তখন রমজান মাস ছিল। টাকার অভাবে ও শারীরিক অসুস্থতার কারনে না খেয়েই রোজা রাখতেন তিনি। এ অবস্থাতেই ২৭শে রমজান ইন্তেকাল করেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই কবি।
তাকে কোথায় দাফন করা হবে তা নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। প্রখ্যাত সাংবাদিক আসাফউদ্দৌলা রেজাসহ অনেকেই সরকারিভাবে কোন জায়গা পাওয়া কিনা চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সরকারিভাবে কোন জায়গা পাওয়া যায়নি। অবশেষে কবি বেনজীর আহমদ তার শাহজাহানপুরের পারিবারিক গোরস্থানে কবিকে দাফন করার জায়গা দান করেন।
দেশ স্বাধীন হবার পর কিছু স্বার্থান্বেষী মহল তাঁর প্রতি চরম অবহেলা ও উদাসীনতা প্রদর্শন করলেও বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তিনি প্রতিভার যে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন তা যুগ যুগ ধরে বাঙ্গালী জাতির জীবনে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।