সুখ স্মৃতি: আবির্ভাব থেকে ইত্তেফাক -০৯
।। নাসিম আনোয়ার।।
ডিসেম্বরের শ্রাবন্তী।
মুক্তিযদ্ধ ভিত্তিক গল্প। প্রকাশ হয়েছিলো বেতার বাংলা পত্রিকায়।
মুক্তিযদ্ধ ভিত্তিক গল্প। প্রকাশ হয়েছিলো বেতার বাংলা পত্রিকায়।
পত্রিকার সম্পাদক কবি শামসুল ইসলাম। তিনি নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন, ভীষণ আন্তরিক ছিলেন। আমাদের বয়সী পুচকি ছোকরা যারা ছিলাম তাদের প্রায়, সবাইকে তুই বলে সম্মোধন করতেন। কেনো এক দুপুরে আমি শেরে বাংলা নগর বেতার বাংলা অফিসে পৌছে গেলাম। সম্পাদক সাহেবের সামনে দাঁড়ালই তিনি তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, বাইছাব আইচোতনি? বইয়ো।বালো আচোতনি?
তুই কোনার কি করোস! চাকরি-বাকরি আছেনি? আমি জবাবে বললাম, জ্বী ভাই দৈনিক সমাচার পত্রিকায়
স্টাফ রিপোর্টার পদে কাজ করি আর কন্টিবিউটার হিসেবে বিভিন্ন কাগজে।
তিনি হাসলেন।বললেন, বালাই তো। তুই তো পরিশ্রমী। সব বিষয় লেখার হাত আছে।
তয়, দুহারে কিছু খাইছোত নি?
আমি বললাম না ভাই। এখনো খাওয়াহয়নি।
তিনি তাঁর অফিসের একজনকে ডেকে খাবার নিয়ে আসতে বললেন।
খাবারের শেষে, দুটো চেক ধরিয়ে দিলেন। একটি চেকে তিন ‘শ টাকা। অপরটি এক’শ পঁচাত্তর টাকা।আমার দেখা আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে পুরোটা নব্বই দশকে ঢাকায় যাঁরা সংবাদকর্মী ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই বিভিন্ন কাগজে গুড কন্ট্রিবিউটার হিসেবে লিখতেন। তবে যারা ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ি বেতন ভাতা ভোগ করতেন তাঁরা ছদ্ম নামে লিখতেন। এক কথায় বাড়তি উপার্জনের জন্য প্রায় সবাই বিভিন্ন কাগজে লিখতেন। আমাদের নিজেদের ভাষায় বলা হতো খেপ মারা ।
বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, স্কাউট, সমবায়, পুলিশ, আনসার ভিডিপি, বাংলাদেশ বিমান,পর্যটন কর্পোরেশন,বেতার, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে সরকারি খরচে বেশ কিছু সাময়িকী বেরুতো। এছাড়া কর্পোরেট হাউজ গুলো থেকে বেরুতো বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ইন হাউজ বুলেটিন।
নবারুণ, সচিত্র বাংলাদেশ, প্রতিরোধ, ডিটেকটিভ, একারণ’ ধান শলিকের দেশ, শিশু ইত্যাদি।
সাংবাদিকা পেসা বরাবরই ঝুঁকিপূর্ণ। কারনে অকারনে কাজ ছাড়তে হতো। রাজনৈতিক মতবিরোধ, ব্যক্তিত্বে আঘাত অথবা প্রতিষ্ঠানের অর্থ সংকটে বেতন ভাতা অনিয়ম ইত্যাদি।
মাত্র কয়েকটি পত্রিকা সংবাদ পত্রের নীতিমালা অনুযায়ি সাংবাদিক-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা এবং উৎসব বোনাস নিয়মিত দিয়ে আসছিলো। এর মধ্যে সবার শীর্ষে ছিলো ইত্তেফাক গ্রুপ। একটি সময় ইত্তেফাক পত্রিকার সাংবাদিক-কর্মচারিরা মাস শেষ হওয়ার আগেই বেতনের বেশির অর্থ ভাউচারের মাধ্যমে তুলে নিতেন।
কারো টাকার প্রয়োজন হলে ভাউচারে টাকার অংক বসিয়ে স্বাক্ষর করে ক্যাশকাউন্টারে জমা দিলেই টাকা দেয়া হতো। মাস শেষে হিসাব বিভাগ বেতন সিটে সংযুক্ত করতো। এমনও ঘটনা আছে। বেতনের চেয়ে বেশি অগ্রিম তুলে নিয়েছেন,সাংবাদিক কর্মচারিরা।
যা পরবর্তী মাসের বেতনের সাথে সংযক্ত করা হতো।
ইত্তেফাকে সাদা,হলুদ-গোলাপী ও নীল রঙের ভাউচার ছিলো।
মালিক পক্ষ অর্থ্যাৎ ব্যরিস্টার মইনুল হোসেন সাহেব নীল রঙের এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেব গোলাপী রঙের আর সাংবাদিক -কর্মচারিরা হলুদ রঙের ভাউচার ব্যবহার করতেন।
বাংলাদেশের গন মাধ্যম জগতে ইত্তেফাক পত্রিকায় কাজ পাওয়া আর সোনার হরিন পাওয়া প্রায় সমান ছিলো।
সাংবাদিক কর্মচারিরা ওয়েজ বোর্ড অনুযাযি বেতন ভাতা এবং দুই ঈদে ছ’টি বোনাস সহ নানান ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতেন।
কারো বড় অংকের টাকার দরকার হলে, ঋণ দেয়া হতো। ব্যাংক টাকা দিতো। ইত্তেফাক কর্তৃপক্ষ গ্রান্টেড থাকতো। বুনিয়াদী পত্রিকা ইত্তেফাকের মালিকপক্ষ অর্থনৈতিক বিষয়ে বেশ উদার ছিলো। প্রতিষ্ঠানে কাজেরও নিশ্চয়তা ছিলো। আজকের দিনে কি অবস্থা বিরাজ তা কর্মরত সাংবাদিক কর্মচারিরাই ভালো জানেন। বর্তমান সময়ে যদি কোনো ব্যপ্তয় ঘটে থাকে এর জন্য দায়ি সাংবাদিক-কর্মচারিরা।
ইত্তেফাক পরিবার মালিকদের আমার খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পুত্র ব্যরিস্টার মইনুল হোসেন ছিলেন সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি ও পরিচালক-এক,
এবং কনিষ্ঠ পুত্র আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ছিলেন সম্পাদক ও প্রকাশক পরিচালক দুই।
এছাড়া সাজু হোসেন, ব্যরিস্টার মইনুল হোসেন সাহেবের স্ত্রী রোববার সম্পাদক। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেবের স্ত্রী তাসমিমা হোসেন( টিপ টিপ)ছিলেন, অনন্যা সম্পাদক। ইত্তেফাকেরও দায়িত্বে ছিলেন।৷ আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস সাহেবের ছোট ভাই মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর সাহেব অনন্যা পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন, পরবর্তী দায়িত্বে ছিলেন তাপস মুজমদার, মলয় পাড়ে,মনোয়ারা মনু সহ অনেকেই। মোহাম্মদপুরের নোটন হাউজে ছিলো অনন্যার কার্যালয় শুরুর দিকে সেখানে আমারও যাতায়াত ছিলো। সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকার পার নারী সাংবাদিকতায় অনন্যার ভূমিকা ব্যপক।
শ্রদ্ধেয় মানিক মিয়ার বড় পুত্রের ডাক নাম ছিলো হিরু মিয়া আর কনিষ্ঠ পুত্রের নাম মঞ্জু মিয়া।
সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা ইত্তেফাক পত্রিকার মালিক পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ। পারিবারিক বিবাদ। বিষয়টি সঠিক নয়।
ওটা ছিলো এক ধরণের পাতানো খেলা, আই ওয়াশ। আমি আর গভীরে যেতে চাই না। নিশ্চিত তারা ভালো মনের মানুষ। সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কতিপয় দুষ্ট লোক ঘিরে রেখেছিলো। তাঁদের আশে পাশেও দুষ্ট লোকের আনাগোনা। সেই সকল দুষ্ট লোকের কবল থেকে তারা আর বেরুতে পারবেন না।
ব্যরিস্টার মইনুল হোসেন চির নিদ্রায় চলে গেছেন । আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুক। আনোয়ার মঞ্জু সাহেবের সুস্থ ও সুদীর্ঘ জীবন কামনা করি।
লেখাটি বড় করতে চাইনি।
যাঁদের উদ্দেশ্যে লেখাটি শুরু করেছিমাম, তাঁদের কথা না বললেই নয়।
সাংবাদিক গীতিকার শিশু সাহিত্যিক শাপলা শালুক পত্রিকার সম্পাদক ফজল এ খোদা,
কথা সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আরেফিন বাদল এবং কবি জাহাঙ্গীর হাবিবুল্লাহ এই অগ্রজ দু’জনই ছিলেন প্রতিরোধ পত্রিকার সম্পাদক। স্বজন ব্যক্তি।
সাংবাদিক সাহিত্যিকদের আপন করে নিতেন খুব সহজেই।
বহুমুখী প্রতিভাধর আরেফিন বাদল বিনোদন সাংবাদিকতার প্রতি ঝোক আর জাঙ্গাঙ্গীর হাবিবুল্লাহ আপদমস্তক কবি।পরবর্তী সময়ে আরেফিন বাদল বিনোদন পত্রিকা তারোকা লোক- এ যোগদান করে ন সৃজনশীল লেখালেখি অব্যাহত রাখেন।
বাংলা একডেমির বার্ষিক সম্মেল ২৫ এ দেখা হলো,কথা হলো কবি জাহাঙ্গীর হাবিবুল্লাহ ভাইয়ের সাথে । তিনি সেই আগের মতোই আছেন।
একটি সময়ে আমি প্রতিরোধ পত্রিকার নিয়মিত লিখতাম।
লেখক সম্মানী ও নিয়মিত পেতাম।
ছড়াকার আশরাফুল মান্নান,অনিমেষ বড়াল এবং চিত্র শিল্পী হেলাল উদ্দিন আহমেদ, আলোক চিত্র সাংসাংদিক হারিস ও মুকুল ভাই সহ অনেকের সাথে আড্ডা হতো খিলগাওয়ের প্রতিরোধ পত্রিকা অফিসে
অপরদিকে আমার মেঝ ভাই মেজর শেখ মোঃ বদরুল #হুদা ছিলেন আনসার ওভিডিপি পরিচালক অপারেশনের দায়িত্বে। তবে ভাইয়ের কারনে প্রতিরোধ পরিকরের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। বরং তিনি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা হওয়ায় আমার জন্য সেটা অস্বস্তির ছিলো। পারিবারিক সম্পর্ক ভালো থাকলেও লেখালেখির কারণে তিনি আমাকে পছন্দ করতেন না।
আমি প্রতিরোধ অফিসে যাই,সেটাও তিনি ভালোচোখে দেখতেন না।