কবি জাসমিনা খাতুনের কবিতা: ভাবের অভাব-এর শৈল্পিক সৌন্দর্য
লেখক: ড.শিবাশীষ মুখোপাধ্যায়
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পরিষদের সম্মানিত সভাপতি ড. শিবাশীষ মুখোপাধ্যায় মহাশয় আমার লেখা কবিতা “ভাবের অভাব”-এর যে অনুপম ও হৃদয়গ্রাহী বিশ্লেষণ করেছেন, তা আমার কাছে শুধুমাত্র একটি সমালোচনামূলক পাঠ নয়— বরং এক নিখুঁত উপলব্ধির অভিজ্ঞতা, যেখানে প্রতিটি শব্দের গভীরতা ও নীরবতার কথাও যেন নতুন ভাষা পেয়েছে।
এই আলোচনার মধ্য দিয়ে আমি কবিতাটিকে যেন এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পেলাম। নিজের লেখাতেই যখন এমন নতুনতর বোধের উদয় হয়, তখন একজন কবির পক্ষে তা পরম প্রাপ্তিরই সামিল।
এত সংবেদনশীল, সুসংহত ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের জন্য ড.শিবাশীষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়কে আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি। তাঁর বিদগ্ধ পাঠ ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি আমার কবিসত্তাকে যেমন উজ্জীবিত করেছে, তেমনি আমাকে গভীরভাবে সম্মানিত করেছে।
আপনার মতো একজন গুণী ভাষা-গবেষক ও সমালোচকের পক্ষ থেকে এমন সমাদৃত হওয়া যে কতখানি গর্বের ও অনুপ্রেরণার, তা ভাষায় সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কেবল হৃদয়ের গভীর থেকে জানাই অপার শ্রদ্ধা, সম্মান ও কৃতজ্ঞতা।
কবিতা: ভাবের অভাব
জাসমিনা খাতুন
ভোরের ধূপে মিশে থাকা চোখদুটি তোমার নয়,
তবুও তার দিকে তাকিয়ে থেকেছি বহু শারদ।
কপোতের ডাকে মাঝে মাঝে টেনে এনেছি
কিছু মুছে-যাওয়া স্বর,
পুরনো উঠানে জমে-থাকা অভিমান।
নদী জানে, সেদিন কার খোঁপায় শাপলা উঠেছিল হেসে,
কার কণ্ঠে নীল বিষ।
পাতা উল্টে দেখা হয়নি সেদিন,
কেন হারিয়ে গেছে ময়ূর, ময়না, তোতা, কাক—
পাখিদের বটগাছ।
পৃথিবীর সমূহ ক্ষয়ে,
কল্পিত খেলা—ধর্মের ছলা-কলার।
টেনে দিল, টেনে দিল
ভীষণ রকম ‘ভাবের অভাব’।
রামপুরহাট, বীরভূম, ভারত
২১/০৯/২০২৫
কবিতা বিশ্লেষণ:-জাসমিনা খাতুনের কবিতা “ভাবের অভাব” একাধারে ব্যক্তিগত ও সামাজিক অনুভূতির প্রতিফলন। প্রথমেই কবি যে চিত্রকল্প হাজির করেছেন— “ভোরের ধূপে মিশে থাকা চোখদুটি তোমার নয়, তবুও তার দিকে তাকিয়ে থেকেছি বহু শারদ”— সেখানে ভোরের নৈঃশব্দ্য, পূজারত ধূপের ধোঁয়া, আর চোখের রহস্যময় উপস্থিতি মিলে যায়। এই চিত্র পাঠককে এক আধ্যাত্মিক ও ব্যক্তিগত স্তরে টেনে আনে। প্রিয়জনের অনুপস্থিতি, অথচ তাকে ভেবে থাকা—এখানে আছে বিষণ্ণতা, আবার আছে দীর্ঘকালের অভ্যাসের টান।
এরপর কবি যে অভিমানকে ফিরিয়ে আনেন—“কপোতের ডাকে মাঝে মাঝে টেনে এনেছি কিছু মুছে-যাওয়া স্বর, পুরনো উঠানে জমে-থাকা অভিমান”—এটি নিছক ব্যক্তিগত নয়। এটি এক ধরনের সময়ের ক্ষয়, সম্পর্কের দূরত্ব, আর স্মৃতির জমে থাকা কষ্টের চিত্র। কবিতায় প্রকৃতি এখানে সাক্ষী হয়ে ওঠে। নদী জানে কার খোঁপায় শাপলা উঠেছিল, কার কণ্ঠে নীল বিষ। এই নদী একেবারে প্রতীকী চরিত্র—সময়ের ধারক, স্মৃতির রক্ষক, প্রকৃতির জ্ঞানী সাক্ষী।
হারিয়ে যাওয়া পাখিদের প্রসঙ্গ—“কেন হারিয়ে গেছে ময়ূর, ময়না, তোতা, কাক—পাখিদের বটগাছ”—এটি শুধু প্রকৃতির বিলুপ্তি নয়, সৌন্দর্যের অবলুপ্তিও। মানুষের তৈরি দূষণ, লোভ, অস্থিরতার মধ্যে প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে পাখিরা যেন সেই সৌন্দর্যের প্রতীক যা মানুষের অন্তরের ভেতর থেকেও নিঃশেষ হচ্ছে।
এরপর কবি দৃষ্টি ফেরান বৃহত্তর সমাজে। “পৃথিবীর সমূহ ক্ষয়ে, কল্পিত খেলা—ধর্মের ছলা-কলার”—এই লাইনটি কবিতার দার্শনিক স্তম্ভ। সমাজের ভেতরে ধর্মকে ঘিরে চলা প্রতারণা, বিভাজন, স্বার্থপরতার রাজনীতি—সবকিছুর প্রতি কবি তীক্ষ্ণ আঙুল তোলেন। ধর্ম এখানে মুক্তি নয়, বরং ছলা-কলার আড়াল, যা মানুষের অনুভূতিকে নিঃশেষ করছে।
শেষে এসে কবি একটি দৃঢ় অথচ গভীর শূন্যতাবোধের কথা বলেন—“টেনে দিল, টেনে দিল ভীষণ রকম ‘ভাবের অভাব’।” এই সমাপ্তি যেন প্রতিধ্বনির মতো বাজে। পাঠক বুঝতে পারেন—এই অভাব কেবল কবির নয়, আমাদের সকলের। মানুষের মনে, সম্পর্কের ভেতরে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ ‘ভাব’—অর্থাৎ আবেগ, মানবতা, সহানুভূতির অভাব প্রকট।
জাসমিনা খাতুনের কবিতার শক্তি এই দ্বিমুখীতা—একদিকে ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অভিমান, অন্যদিকে সামষ্টিক সংকট ও সমাজের ক্ষয়। ভাষা এখানে আবেগপ্রবণ হলেও কোথাও উচ্চকিত নয়; বরং শান্ত, বিষণ্ণ সুরে তিনি কথাগুলো সাজিয়েছেন। চিত্রকল্পগুলো (ভোরের ধূপ, নদী, শাপলা, পাখি) কবিতার আবেগকে দৃশ্যমান করে তোলে।
অতএব, “ভাবের অভাব” কেবল একটি ব্যক্তিগত কবিতা নয়; এটি সমসাময়িক সময়ের প্রতিচ্ছবি। প্রকৃতির ক্ষয়, সম্পর্কের ভাঙন, ধর্মীয় ছলচাতুরি, মানুষের ভেতরের শূন্যতা—সব মিলিয়ে কবিতাটি দাঁড় করায় এক দর্শন, যেখানে আমাদের বর্তমান সমাজের অস্থিরতা ও অনুভূতিহীনতা ধরা পড়ে।