জীবনের রিকশা। স্মৃতিচারণ। সুলেমান আল আজাদ

সাহিত্য

by protibimbo
০ মন্তব্য ৩৩ বার পড়া হয়েছে
জীবনের রিকশা
সুলেমান আল আজাদ
উৎসর্গ: আমি এই লেখা উৎসর্গ করছি, আমার প্রয়াত পিতা তাজ ইসলাম ও মা নূর জাহান খানমকে, যাঁদের নেক দোয়া আর পরম স্নেহমমতা আমার জীবনের প্রতিটি সংগ্রামে আলো হয়ে জ্বলেছে। আর উৎসর্গ করছি সেই সমস্ত শ্রমজীবী ভাই-বোনদের, যাঁহারা ঘাম ঝরিয়ে জীবনের মানে খুঁজে পান। যাঁহারা জানেন- “শ্রমই জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রার্থনা।”
ভূমিকা: জীবনকে আমি দেখেছি খুব কাছ থেকে- অভাব, পরিশ্রম, অপমান, আবার ভালোবাসা ও প্রেরণা। রিকশার প্যাডেলে আমি ঘুরিয়েছি কেবল চাকা নয়, ঘুরিয়েছি ভাগ্যের দিকও। কলম আমার কাছে বিলাস নয়, কলম আমার কাছে প্রয়োজন। এটি আমার মনের মুক্তি, আমার আত্মার কণ্ঠস্বর। যদি আমার এই গল্প পড়ে কেউ নতুন করে বাঁচার সাহস পায়, তাহলেই আমার লেখা হবে সফল।
অধ্যায় ১: শৈশবের আলো-আঁধারি: সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার ৩ নং ফেনার বাঁক ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী লক্ষ্মীপুর গ্রামে আমার জন্ম। ১৯৭০ সালের ১৯ মে, রোজ সোমবার এই মায়াময় ছায়াঘেরা পৃথিবীতে আমার আগমন। অভাব ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী, কিন্তু মায়ের দোয়া ছিল আমার মাথার ছায়া। বাবা বলতেন, “মানুষ হতে হলে কষ্টকে সঙ্গী করতে হয়।”
অধ্যায় ২: অভাবের ছায়ায় শিক্ষা: লক্ষ্মীপুর জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া দাখিল মাদ্রাসায় শুরু হয় আমার পড়াশোনা। কিন্তু অভাবের টান যেন ছায়ার মতো ঘিরে ধরেছিল আমায়। শুধু বর্ষা মৌসুমে ছয়মাস লেখাপড়া করতে পারতাম। আর হেমন্তের ছয়মাস অন্যের বাড়িতে গরু রাখালের কাজ করতাম। বার্ষিক পরীক্ষা হেমন্তকালে হলে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারতাম না। শিক্ষকগণ মাদ্রাসার হাজিরার খাতা থেকে আমার নাম কেটে দিতেন। হতাশ হয়ে ফিরে গিয়ে ভর্তি হলাম আমাদের গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, সেখানেও একই অবস্থা হতো। পেটের দায়ে জীবন বাঁচাতে আমাকে কাজে যেতেই হতো। আমার এই অবস্থা দেখে গ্রামের মানুষ হাসাহাসি করতো, বলতো এক হাতে দুই ফল খাওয়া যায় না, তারচেয়ে বরং একতরফাভাব কাজ লেগে যাও। আমি তখন কোনো জবাব না দিয়ে কেবল নীরবে ভাবতাম- আর মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম একদিন আমারও কিছু হবে। যেভাবেই হোক আমি লেখাপড়া করবো। এইভাবে কঠিন সংগ্রাম-এর মধ্যদিয়ে কোনো রকম চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেই থেমে যায় আমার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা। কিন্তু আমার শেখার আকাঙ্ক্ষা কখনো থেমে যায়নি। কাজের ফাঁকে যখনই সময় পেতাম, বেশি বেশি করে গল্প উপন্যাসের বই পড়তাম। আর সবসময় জ্ঞানীগুণী মানুষকে অনুসরণ করে চলতাম, গল্প উপন্যাসের বই পড়তে পড়তে একসময় বাংলা পড়ার কলাকৌশল নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে আসলাম। সাথে হাতের লেখাও, তবে কঠিন বানান হলে এখনো একটু-আটটু অসুবিধা হয়।
অধ্যায় ৩: শ্রমের জীবনে পদার্পণ: শৈশবের পরেই শুরু হয় কঠিন বাস্তবতা। অন্যের বাড়িতে কাজ করতাম, দিনে পরিশ্রম, রাতে নিঃসঙ্গতা। কখনো ক্ষুধা, কখনো ক্লান্তি, তবু মনে ছিল দৃঢ়তা- বাঁচতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কার্তিক মাসের প্রথম তারিখে গৃহস্থের বাড়িতে যেতাম, আর জ্যৈষ্ঠ মাসের পনের তারিখে ছুটি পেতাম। এরমধ্যে যদি অসুখ-বিসুখ হতো, আর অসুস্থতার কারণে নিজের বাড়িতে থাকতাম, পরবর্তীতে জ্যৈষ্ঠ মাসের পনের তারিখের পর, সেইদিনগুলোর খাটুনি খেটে দিয়ে আসতে হতো। এভাবেই চলতে চলতে একসময় যৌবনে পদার্পণ করলাম। এই পরিশ্রমই আমাকে তৈরি করেছে একজন দৃঢ় মানুষ হিসেবে।
অধ্যায় ৪: ভালোবাসার আলো: যৌবনের প্রান্তে এসে জীবনে আসে আলো। একই গ্রামের ফাতেমা বেগম, জনাব শুকুর আলী মুন্সী ও কোকিলা বানুর স্নেহের সর্বকনিষ্ঠা কন্যা। তাঁর সরলতা আর কোমল হাসি আমার মন কেড়ে নেয়। আমরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। তাতে আল্লাহ দান করেন এক কন্যা ও এক পুত্রসন্তান। সংসার সুখের হলেও অভাব তখনো অদৃশ্য ছায়ার মতো পিছু ছাড়েনি। তখন অভাব আরও চতুর্দিক থেকে এসে অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরেছিল।
অধ্যায় ৫: রিকশার প্যাডেলে জীবনযুদ্ধ। অভাবের তাড়নায় পরিবার নিয়ে চলে যাই সুনামগঞ্জ জেলারই আরেক উপজেলা জগন্নাথপুরের রসুলগঞ্জ বাজারের পাশে দরীখুঞ্জণপুর গ্রামে। দরীখুঞ্জণপুর-এর জনাব আব্দুল কাদির ও শরীয়ত খানের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে, রিকশা চালাতে শুরু করি। দিনে ঘাম, রাতে ক্লান্তি, তবু মনে আশা- ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হবে। আমার জীবনের মতো ছেলেমেয়ের জীবন যেন না হয়। তাই একাধারে বিশ বছর রিকশা চালিয়েছি, বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, শুধুমাত্র ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করার জন্য। মেয়ে আলিম পাশ করেছে, বিয়ে দিয়েছি, ছেলে বিএ পাশ করেছে। এখন দুই ছেলে তিন মেয়ে নিয়ে পাঁচজনের পরিবার। সবার খাওয়া পড়া সব একহাতেব করছি। তবু আমার কলম থামাইনি। সারাদিন রিকশা চালাতাম আর রাতে লিখতাম আমার মনের কথা। লিখতাম আমার জীবনের ফেলে আসা দিনের কথা, লিখতাম বিনা মেঘে বজ্রপাতে ভেঙে যাওয়া আমার স্বপ্নের কথা, লিখতাম অর্থসম্পদ না থাকার কারণে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া ভালোবাসার কথা। আমার জীবনের দুঃখ-সুখ, পরিশ্রম আর স্বপ্নের কথা লিখতাম কবিতার ছন্দে-ছন্দে।
অধ্যায় ৬: রসুলগঞ্জ এলাকায় থাকাকালীন একটা বিষয় আমার হৃদয় কন্দরে বার বার নাড়া দেয় যে, উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুজাদ্দিদে জামান, রইসুল কুররা ওয়াল মুফাসসিরীন, উস্তাদুল মুহাদ্দিসীন, শামসুল উলামা হযরত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী (সাহেব কিবলাহ ফুলতলী) রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর অমর সৃষ্টি “দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট।” অর্থাৎ বিশুদ্ধ কোরআন তেলাওয়াতের এক অনন্য নিদর্শক। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বিশুদ্ধ কোরআন তেলাওয়াত শুনে আমি মুগ্ধ হই। আমার ছেলেমেয়েদেরকেও পড়াই। সেই সুবাদে আমার মনে প্রবল ইচ্ছা জাগে যে, যদি দারুল কিরাতের একটা শাখা আমার গ্রামের বাড়িতে নিতে পারতাম। তাহলে কতই না ভালো হতো। অবশেষে অনেক সাধনার বিনিময়ে ২০১২ সালের রমাদান মাসে আমাদের গ্রামের দাখিল মাদ্রাসায় একটা শাখা ফুলতলী থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। যার জন্য আমার সঙ্গে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন রসুলগঞ্জ মাদ্রাসার বর্তমান শিক্ষক জনাব মাওলানা এনাম উদ্দিন আহমদ, আলী মুহাম্মদ ইউসুফ ভাই, সাবেক ছাত্রনেতা হুমায়ুন ভাই, শাহ জাহান ভাইসহ নাম না জানা আমার গ্রামের প্রতিটি মানুষ। যেকারণে দু’দফায় রমাদান মাসে রসুলগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়িতে যাই আমি। কথা ছিল যে, আমার গ্রামের মানুষ দারুল কিরাত সম্পর্কে কোনো টাকা খরচ করতে হবে না। শুধুমাত্র থাকা আর খাওয়ার জায়গা দিলেই হবে। হয়েছেও তাই। ক্বারী সাহেবরা থেকেছেন মাদ্রাসায় আর খেয়েছেন বিভিন্নজনের বাড়িতে। যেভাবে দারুল কিরাতের জন্য পরিশ্রম করেছিলাম, সেভাবে সুফলও পেয়েছি। কেননা আমাদের গ্রামের লোকজন এমনও বলেছেন যে, এবার মনে হয়েছে আমাদের গ্রামে রোজা এসেছিল। না হয় আমরা বুঝতেই পারতাম না রোজা কেমন আসতো আর কেমন চলে যেত। কারণ রোজা মাসে প্রকাশ্যে খাওয়াদাওয়া করে আমরা অভ্যস্ত! ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! নিজে কাছাকাছি না থাকার কারণে শাখা কেন্দ্রটি জিন্দা রাখতে পারিনি।
অধ্যায় ৭: কলমের মানুষ হয়ে ওঠা: আমার লেখা একদিন দেখেন, লোহারগাঁও গ্রামের বাসিন্দা, বাংলাদেশ আঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামীয়া সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সাবেক সভাপতি ও স্বনামধন্য লেখক আলী মুহাম্মদ ইউসুফ ভাই। আমার লেখা পড়ে তিনি বলেন, সুলেমান ভাই; আপনি লিখে যান, আপনার কলমে জীবন আছে। আলী মুহাম্মদ ইউসুফ ভাইয়ের সুবাদে পরিচয় হয় বাগেরহাট জেলার স্বনামধন্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি জনাব জহির মুহাম্মদ ভাইয়ের সাথে। তিনি আমার লেখা দেখে, প্রশংসা করে আমাকে স্বভাব কবি বলে ডাকতেন। এরপর পরিচয় হয় বাংলার বুলবুলখ্যাত জননন্দিত কবি ও ইসলামী সংস্কৃতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্তে জনাব মুজাহিদুল ইসলাম বুলবুল ভাইয়ের সাথে। উনিও আমাকে উৎসাহিত করেন এবং আমাকে সাথে নিয়ে ছবি তোলেন। এরপর দেখা হয় রতিয়ার পাড়া নিবাসী ও লন্ডন প্রবাসী জনাব হযরত আলী খান সাহেবের সাথে। তিনিও আমার লেখার প্রশংসা করে সুন্দর একটি বাণী লিখে দেন আর বলেন লেখা চালিয়ে যান, এই লেখায় একদিন কথা বলবে। এই উৎসাহেই নতুন করে শুরু হয় আমার সাহিত্যযাত্রা। আমার পীর ও মুর্শিদ আরব আমিরাতের সাবেক বিচারপতি উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ শায়খুল হাদিস হযরত আল্লামা হাবীবুর রহমান রহমতুল্লাহি আলাইহি আমার লেখা পড়ে খুব প্রশংসা করেন এবং দোয়া করে দেন। আর আদেশ করেন লেখালেখি চালিয়ে যেতে এরপর আলী মুহাম্মদ ইউসুফ ভাইয়ের পরামর্শে একটি মোবাইল কিনি। সেই মোবাইল দিয়েই ফেসবুকে লেখা পোস্ট করা শুরু করি। মানুষ পড়তে থাকে, মন্তব্য করে, উৎসাহ দেয়। তখন আমি বুঝতে পারি রিকশাওয়ালা থেকে লেখককে পরিণত হওয়া অসম্ভব নয়।
অধ্যায় ৮: আজও চলছি: আজ আর রিকশা চালাতে পারি না। সময় বদলেছে, শরীর ক্লান্ত, হার্টের হাড় ক্ষয় হয়ে গেছে, এখন জীবন ধীরগতিতে চলছে। তবুও আমি থেমে থাকিনি, এখন আমি একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা বিভাগের কাজ করছি। দিনে দায়িত্ব পালন করি, রাতে কলমে লিখি জীবনগাথা। আমার কলম এখন আমার শ্বাসপ্রশ্বাস। এই কলম আমাকে বাঁচিয়ে রাখে, এই কলম আমাকে দিয়েছে পরিচয় “একজন লেখক, সুলেমান আল আজাদ।”
উপসংহার: জীবনের রিকশা; জীবন আমার কাছে এক চলমান রিকশার মতো- কখনো উঁচু পথ, কখনো নিচু পথে চলতে, কখনো ঝড়-বৃষ্টি, আবার কখনো রোদেলা সকাল। এই যাত্রায় আমি শিখেছি- “কষ্টই মানুষকে গড়ে, আর কলমই তাকে অমর করে।” আমি কৃতজ্ঞ সেই সকল মানুষদের প্রতি। যাঁহারা আমার জীবনের পথচলায় পাশে ছিলেন, যাঁহারা বিশ্বাস করেছেন, একজন রাখালও একদিন লেখক হতে পারে।
——————————————-
২৩/১০/২০২৫ ইং

সম্পর্কিত খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আবুল খায়ের 

নির্বাহী সম্পাদক: 
বার্তা প্রধান:

অফিস: বাড়ি ০৭, সড়ক ১৪/সি, সেক্টর ৪,

উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।

যোগাযোগ: ০১৭১৫৩৬৩০৭৯

বিজ্ঞাপন: ০১৮২৬৩৯৫৫৪৯

Email: khair.hrm@gmail.com

info@dainikprotibimbo.com

protibimboprokash.com

Facebook

©2025 Dainik Protibimbo – All Right Reserved. Designed and Developed by Bangla Webs