রাজধানীর পল্লবী থানার বাইতুন নুর এলাকার ব্যবসায়ী হেলাল উদ্দিন। গত বছরের ২৮ নভেম্বর কবির নামে এক ব্যক্তি তার কাছে ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। কিন্তু চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় কবির তাকে মামলায় জড়ানোর হুমকি দিয়ে চলে যান। ওই দিনই খিলগাঁও থানায় কবিরের বিরুদ্ধে জিডি করেন হেলাল উদ্দিন। পরে যাত্রাবাড়ী থানার একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে হেলালকে আসামি করেন কবির। গত ৭ সেপ্টেম্বর এ মামলায় হেলাল উদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরের দিন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এখনও তিনি কারাগারে রয়েছেন।
শুধু হেলাল উদ্দিনই নন, নিরপরাধ অনেক সাধারণ মানুষকে জুলাই আন্দোলনে বা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের বিভিন্ন মামলায় হয়রানি করা হচ্ছে বলে মনে করেন ঢাকা মহানগরের আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন। তিনি বলেন, ‘‘জুলাই আন্দোলনের মামলায় দেরিতে চার্জশিট দাখিলের সুযোগে অনেকে মামলা-বাণিজ্য করছে। ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত শত্রুতার সুযোগ নিয়ে অনেককে জুলাই আন্দোলনের মামলায় আসামি করা হচ্ছে। জুলাই আন্দোলনের মামলাগুলোতে আমরা দেখেছি ঢালাওভাবে আসামি করা হয়েছে। যারা নিরপরাধ, চার্জশিট হলে তাদের মুক্তির একটা সুযোগ থাকতো। চার্জশিটে দেরি হওয়ায়, কেউ কেউ অপরাধী না হয়েও জেল খাটছেন। এটা তো এক ধরনের সাজা। আবার যাদের নাম এজাহারে যুক্ত করা হয়েছে, তারাও আতঙ্কে আছেন। ভয় নিয়ে সারাক্ষণ চলতে হচ্ছে। এর ফলে তারা পারিবারিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
১৪ মাসে ৭২৯ মামলা, চার্জশিট হয়নি একটিরও
আদালত সূত্রে জানা গেছে, জুলাই আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথম মামলাটি হয় ১১ আগস্ট। এরপর গত ১৪ মাসে রাজধানীর ৫০ থানায় মোট মামলা হয়েছে ৭২৯টি। কিন্তু একটি মামলারও চূড়ান্ত চার্জশিট এখনও আদালতে দাখিল করা হয়নি। তবে গত বছরের ২২ অক্টোবর জুলাই আন্দোলন-সংক্রান্ত গুলশান থানার একটি মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের নারাজির কারণে সেই মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। ফলে ওই চার্জশিট কার্যকারিতা হারায়।
অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে সমাধান দেখছেন। তারা মনে করেন, যথাযথভাবে তদন্তের জন্য চার্জশিটে সময় লাগছে। তাই অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন সাধারণ মানুষের হয়রানি রোধ করবে। যদিও অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনকে সমাধান হিসেবে দেখছেন না আইনজীবীরা।
চার্জশিট দিতে এত সময় লাগার কারণ কী, প্রশ্নে রাষ্ট্রপক্ষের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘জুলাই আন্দোলনের মামলাগুলোর মধ্যে ১৫টির মতো চার্জশিট তৈরি হয়েছে। শিগগিরই আপনারা সেটি দেখতে পারবেন।’’ তদন্তকাজে কোনও দেরি বা গাফিলতি দেখছেন না তিনি। ‘‘যথাযথ ও ভালো কাজে কিছু সময় লাগা স্বাভাবিক’’, বলেন ফারুকী।
অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন করা হয়েছিল মূলত মানুষকে হয়রানি থেকে মুক্ত করার জন্য। জুলাই আন্দোলনের বিভিন্ন মামলায় সাধারণ মানুষকেও অপরাধী করা হয়েছে, এরকম একটি কথা প্রচলিত আছে। সেজন্য সরকার সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাগবের উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা একটা ভালো সিদ্ধান্ত। আমরা মনে করি, আমাদের যেকোনও মামলাই তো তদন্ত করে পুলিশ। শুধু তদন্ত কর্মকর্তাই তদন্ত করবেন, শুধু সেটা না। ঊর্ধ্বতনরা অব্যাহতির বিষয়টি নজরে রাখবেন। এতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন। হয়রানি দূর হবে।’’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শামসুদ্দোহা সুমন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘আমাদের জানা মতে গুলশান থানার একটি মামলায় সব আসামিকে অব্যাহতি দিয়ে একটি চার্জশিট আদালতে এসেছিল। চার্জগঠনের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমরা নারাজি দিয়েছি। পরে আদালত অধিকতর তদন্তের জন্য মামলাটি ফেরত পাঠান। এছাড়া আর কোনও চার্জশিট আমরা পাইনি।’’
চার্জশিট প্রদানে দেরি হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘জুলাই আন্দোলনের মামলাগুলোতে আমরা চাই যথাযথ তদন্ত হোক। তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত আসামি বেরিয়ে আসুক। নিরপরাধরা মুক্তি পাক। নতুন বাংলাদেশে কারও প্রতি যেন ন্যূনতম জুলুম করা না হয়, আমরা সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করছি।’’
‘‘মানুষকে আরও বেশি ভোগান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে’’
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন বিষয়টি শুনতে ভালো মনে হলেও এর ভেতরে অনেক ফাঁকফোকর আছে। এটার মাধ্যমে পুলিশের বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়। তারা চাইলে তদন্ত থেকে যে কাউকে অব্যাহতি দিতে পারে, আবার নাও দিতে পারে। অবাধ সুযোগ রয়েছে পুলিশের। যাদের অব্যাহতি দেওয়া হবে না, তাদের জামিন পাওয়া কঠিন হবে। অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের কারণে চূড়ান্ত চার্জশিট দাখিলে দেরি করার সুযোগ বেড়ে যায়। কারণ, পুলিশ তখন অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বেশি মনোযোগ দেবে। এতে তাদের লাভবান হওয়ার সুযোগ বেশি। অস্থায়ী চার্জশিটের কারণে একদিকে মানুষের হয়রানি ও ভোগান্তি বাড়ার শঙ্কা বাড়ছে, অপরদিকে তদন্ত কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা গ্রহণের প্রতি মনোযোগ বাড়ে।’’
তিনি মনে করেন, অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের নিয়ম তৈরি না করে চার্জশিটের জন্য পুলিশকে সময় বেঁধে দেওয়া উচিত ছিল। এই সময়টা ১৮০ দিন হতে পারতো। যদি কোনও কারণে পুলিশ ১৮০ দিনের মধ্যে চার্জশিট দিতে না পারে, তখন আরও ৬০ দিন বোড়ানো যেতো। তারপরও যদি পুলিশ চার্জশিট দিতে না পারে, তাহলে তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রাখা যেতো।
আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম বলেন, ‘‘এখন আমরা যেমন দেখি ১০-১২ বছর হয়ে গেলেও কোনও মামলার চার্জশিট হয় না। এর ফলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, দীর্ঘ সময় ধরে তাদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন অর্থশালীদের ভোগান্তি থেকে বাঁচালেও সাধারণ মানুষকে আরও বেশি ভোগান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’’
