লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়্যারের গবেষকরা। তারা পেয়ারা গাছ থেকে প্রাপ্ত বিশেষ অণুর (মলিকিউল) একটি বিকল্প পথ আবিষ্কার করেছেন, যা লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসায় সাশ্রয়ী ও কার্যকর পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
রসায়ন ও জৈব রসায়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উইলিয়াম চেইনের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণায় প্রয়োগ করা হয়েছে ‘ন্যাচারাল প্রোডাক্ট টোটাল সিনথেসিস’ নামের এক বিশেষ প্রক্রিয়া। এর মাধ্যমে পরীক্ষাগারে অল্প খরচে এবং বৃহৎ পরিসরে পেয়ারা-জাতীয় অণুগুলো পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়েছে। গবেষকদের মতে, এই উদ্ভাবন বিশ্বজুড়ে লিভার ক্যান্সারের চিকিৎসা সহজলভ্য করতে পারে, যেখানে বর্তমানে চিকিৎসার ব্যয় অত্যন্ত বেশি এবং রোগীদের বেঁচে থাকার হার আশঙ্কাজনকভাবে কম।
প্রকৃতির ভাণ্ডার ও আধুনিক চিকিৎসা
প্রকৃতি সব সময়ই আধুনিক চিকিৎসার অন্যতম উৎস। উইলো গাছের ছাল থেকে তৈরি সালিসিন যেমন পরে অ্যাসপিরিনে রূপ নেয়, তেমনি অসংখ্য উদ্ভিদজাত যৌগ আধুনিক ওষুধে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে এসব যৌগ বৃহৎ পরিসরে সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের দলটি সেই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পরীক্ষাগারে সহজলভ্য রাসায়নিক ব্যবহার করে পেয়ারার অণুগুলো পুনর্গঠন করেছেন। এর ফলে গবেষকরা পর্যাপ্ত পরিমাণ যৌগ উৎপাদন করতে পারবেন, যা ভবিষ্যতে ক্লিনিক্যাল ব্যবহারেরও পথ সুগম করবে।
চেইনের দল যে অণুটি পেয়ারা থেকে চিহ্নিত করেছেন, তা লিভার ও পিত্তনালীর ক্যানসার চিকিৎসায় কার্যকর সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। এসব ক্যানসার চিকিৎসার ক্ষেত্রে অত্যন্ত জটিল এবং যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ এতে আক্রান্ত হন। দেরি পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে পাঁচ বছরের মধ্যে বেঁচে থাকার হার ১৫ শতাংশেরও কম। পরীক্ষাগারে সংশ্লেষণ (সিনথেসিস) করা এই যৌগগুলো ক্যানসারের বিরুদ্ধে কীভাবে কাজ করছে তা দ্রুত ও কার্যকরভাবে যাচাই করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান ওষুধের সঙ্গে মিলিয়ে নতুন চিকিৎসা পদ্ধতিরও সুযোগ তৈরি হবে।
কম খরচে বিশ্বজুড়ে ব্যবহারযোগ্য
এই গবেষণার সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো অণুগুলোকে কম খরচে ও সহজ প্রক্রিয়ায় তৈরি করার সক্ষমতা। উইলিয়াম চেইন বলেন, “আজকের দিনে ব্যবহৃত বেশিরভাগ ওষুধই হয় প্রাকৃতিক উৎস থেকে তৈরি, নয়তো সেগুলোর ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকায় চাহিদা মেটানো যায় না। এখন আমাদের প্রকাশিত পদ্ধতি অনুসরণ করে যে কোনো গবেষক নিজেই পরীক্ষাগারে এসব অণু তৈরি করতে পারবেন।” এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও সাশ্রয়ী মূল্যে লিভার ক্যানসারের চিকিৎসা সম্ভব হবে।
বিশ্বজুড়ে সহযোগিতা ও ভবিষ্যৎ গবেষণা
এই আবিষ্কার ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক আগ্রহ কেড়েছে। গবেষণায় প্রথম লেখক ডক্টরাল শিক্ষার্থী লিয়াম ও’গ্রেডি বলেন, “আমরা প্রথমে অজানা পথে পা বাড়িয়েছি। এখন অন্যরা সেই পথ ধরে এগোতে পারবে, শর্টকাট খুঁজে নিতে পারবে। আমরা শুধু পথ দেখিয়েছি।” গবেষণা দল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কাজ করছে, যাতে এই পেয়ারাজাত অণুগুলো অন্য ক্যানসারের বিরুদ্ধেও কার্যকর কি না, তা পরীক্ষা করা যায়।
বৈশ্বিক প্রভাবের সম্ভাবনা
বিশ্বজুড়ে লিভার ও পিত্তনালীর ক্যানসারের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এই বাস্তবতায় কার্যকর ও সাশ্রয়ী চিকিৎসা আবিষ্কার অত্যন্ত জরুরি। ডেলাওয়্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের এই উদ্ভাবন শুধু চিকিৎসার ব্যয় কমাবে না, রোগীদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও বাড়াবে। এ গবেষণা আবারও প্রমাণ করল, প্রকৃতির অনুপ্রেরণায় তৈরি ওষুধ ভবিষ্যতের চিকিৎসাবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই নতুন দিগন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানে আশার আলো জ্বালাচ্ছে, যেখানে একসময় লিভার ক্যানসারের চিকিৎসা ছিল সীমিত এবং ব্যয়বহুল। এখন হয়তো সাধারণ মানুষের নাগালেই আসবে কার্যকর চিকিৎসার পথ।