ফজলুল হক সৈকত লিখেছেন: তসলিমা হাসানের ছোটগল্পে জীবনের পাপ ও তাপ

সাহিত্য

by protibimbo
০ মন্তব্য ২২৫ বার পড়া হয়েছে

তসলিমা হাসানের ছোটগল্পে জীবনের পাপ ও তাপ
বই আলোচনা
ফজলুল হক সৈকত, টরন্টো, কানাডা

কাঠামো আর প্রকাশ-কৌশল নিয়ে নানান বিতর্ক এবং মতভেদের ভেতর দিয়ে ছোটগল্প বিচিত্র পথে অগ্রসর হয়েছে। কারণটা সম্ভবত এই যে, গল্প সবসময়ই গল্প – তা মানুষের জীবনের সাথে, অনুভবের সাথে মিশে থাকে; লেখক শুধু নিজের অভিজ্ঞতাকে উপলব্ধির সাথে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন মাত্র। একেক জন গল্পকার একেক রকম গল্প লেখেন তাঁর প্রাতিস্বিক বিচরণ, শিক্ষা ও রুচিকে অবলম্বন করে। গল্পকাররা যে খুব বেশি তত্ত্ব বা থিওরি মেনে চলেন, তেমনটা নয়। হয়তো গবেষক বা সমালোচক গল্পে তত্ত্বের সন্ধান করেন পেশাগত বা বৈশিষ্ট্যগত কারণে; কিন্তু গল্পনির্মাতা থাকেন অনুভূতির অনুগামী। তাঁর মন যেভাবে বলে, গল্পের শরীর ও রক্ত-প্রবাহ ঠিক সেভাবেই রাস্তা খুঁজে নেয়। এমনটি ঘটে কালচারাল সারাউন্ডিংস-এর প্রভাবে; সংস্কৃতি আর প্রতিবেশ গল্পকারকে সবচেয়ে বেশি তাড়িত করে। বাংলাদেশি-কানাডিয়ান গল্পকার তসলিমা হাসানের ‘নির্বাচিত গল্প’ বইটি পড়তে গিয়ে খুব স্বাভাবিক এই কথাগুলো বারবার মনের কোণে ভাসছিল। তিনি যে তাঁর কাল ও পরিজনকে মমতায় বেঁধেছেন গল্পের সুতোয়, তা টের পাওয়া যায়। এটি তসলিমার সাংস্কৃতিক বোধ; তাঁর আজন্ম-লালিত স্বপ্ন ও জীবন-যাত্রার গান এইসব গল্প।

তসলিমা হাসান একজন গল্পকার। একজন মডেল। এছাড়া কবিতাচর্চা, গান রচনা এবং অভিনয়ের সাথেও যুক্ত রয়েছেন। কবি ইকবাল হাসানের সাথে সংসার করতে গিয়ে দেখেছেন জীবনের নানান বৈচিত্র্য। একজন সৃজনশীল মানুষের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে, শৈশবে ভালোলাগা সাহিত্যচর্চার ক্ষণিকপ্রভা, নিজের ভালোলাগা-মন্দলাগার অনুভব হয়ে উঠে এসেছে আপন প্রকাশ-ভাবনায়। সৌন্দর্যকে ধারণ করেছেন তসলিমা হাসান সারাটি জীবন ধরে। তিনি ভালো অভিজ্ঞতা আর আনন্দকে যাপন করতে চেষ্টা করেছেন; দুশ্চিন্তা বা যাপিত জীবনের ক্লান্তি কখনোই তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করতে পারেনি। ফ্যাশন এবং প্যাশনকে তিনি জীবন-উপভোগের পথ ও পাথেয় বলে বিশ^াস করেন। তসলিমার কথাসাহিত্যে মানুষ, তার পরিচয় ও মর্যাদা প্রাধান্য পায় সবসময়। তিনি কথাশিল্পকে আশ্রয় করেছেন অনুভব বিস্তারের আশ্রয় হিশেবে। মডেলিং ছিল তাঁর সুন্দরের পিপাসা নিবারণের পথ মাত্র। মানুষকে ভালোবাসেন তিনি দুহাত মেলে; পেয়েছেন অগণিত মানুষের অপার ভালোবাসাও। বন্ধুত্ব ও সান্নিধ্যকে তসলিমা ব্যক্তিগত জীবনে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। আর সাহিত্য মাধ্যমে জানতে চেয়েছেন মানুষকে, জানাতে ও জাগাতে চেয়েছেন মানুষের মনের অলি-গলির কথা। নয় বছর বয়সে ‘মিনুর লাউ গাছ’ শিরোনামে কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে তসলিমা হাসানের সাহিত্যযাত্রা আরম্ভ হয়েছে। কলেজ ম্যাগাজিনের জন্য লিখেছেন ‘ঝড়’ নামে একটি ছোটগল্প। তারপর অনেকদিন লেখালিখিতে বিরতি ছিল। টরন্টো আসার পর পুনরায় লেখার জগতে প্রবেশ করেন তিনি। ২০০০ সালে ঢাকার দৈনিক ‘জনকণ্ঠ’ পত্রিকায় ছাপা হয় ‘নিঃশব্দে নিশীথে’ নামের ছোটগল্প। এই শিরোনামে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ বের হয় ২০০১ সালে। এখন পর্যন্ত গল্পগ্রন্থ, মৌলিক কাব্য, যৌথকাব্য, উপন্যাস মিলিয়ে প্রকাশিত বই ১৪টি।

তসলিমা হাসানের ‘নির্বাচিত গল্প’ (২০২৪, অভিজয় প্রকাশনী, কলকাতা) তাঁর গ্রন্থিত ১৯টি গল্পের সংকলন। এগুলো লেখকের নিজের বাছাই করা। বইটির ফ্ল্যাপে নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন : ‘তসলিমা হাসানের নাম আমি তার লেখা পড়ে জানলাম। তসলিমা হাসান একজন গল্পকার। আজকাল কবিতার বই-ই বেশি প্রকাশিত হয়, গল্পের বই খুব একটা বেরোয় না। তসলিমা হাসান ব্যতিক্রম। তিনি গল্প লেখেন এবং গল্পকার হিসেবে পাঠকধন্য হয়েছেন। তসলিমার গল্পগুলোর নাম দেখে (নিঃশব্দে নিশিথে, গোধূলি, প্রস্ফুটিতা, জোনাকি জ্বলে, রাজেশ্বরী কুঞ্জ, সুখ-অসুখ) তার কাব্যবোধ বোঝা যায়।’ এ তো গেল ফ্ল্যাপের কথা। অতঃপর পাতা উল্টে ভেতরে প্রবেশ করলে তসলিমার গল্পের বিষয় ও ভাষা সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়।

banner

‘আঁধার কন্যা’ গল্পে রাবেয়া একটি বিকলাঙ্গ কন্যা সন্তান জন্ম দেয়। গল্পটি প্রতীকি; নারীকে যে চিরায়ত সমাজ শত বছরের জঞ্জালের ভেতর স্থাপন করে রেখেছে, তারই শৈল্পিক প্রকাশ ‘বিকলাঙ্গ কন্যা’ সন্তান জন্ম নেওয়ার এই ঘটনাটি। নারীর স্বাভাবিক বিচরণ সত্যি সত্যি বাধাগ্রস্ত – তার প্রচার ও প্রকাশকে সমাজ কখনোই বিকশিত হতে দেয় না, দেয়নি – এই গভীর সত্য কথাটি তসলিমা বলতে চেয়েছেন গল্পের মাধ্যমে। গল্প থেকে খানিকটা বিবরণ তুলে দেওয়া যেতে পারে: ‘অপরাহ্নের ভীষণ রোদের খেলা; আনমনা মেঘের শরীরে নরম রোদের আলো পড়ে রঙের ফানুস ছিটকে বেরোয়। সূর্যের গায়ে সেঁটে থাকা মেঘ সূর্যের মুখে, হঠাৎ করে ছায়া হয়ে যায় চারপাশ। পশ্চিমের অর্ধেক আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে কালো মেঘ। কালচে লাল এই মেঘ সূর্যের আলোতে হয়ে যায় সিঁদুরে মেঘ। কখন যেন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। রাত বাড়লে হৃদয়বিদারক ক্রন্দনের ধ্বনি রাতের মৌনতাকে ভেদ করে এক শিশু জন্মগ্রহণ করে। অনিদ্রার ক্লান্তিতে আবর্তিত হয় রাবেয়ার শরীর। রাহেলা খালার হাতেই শিশুটি জন্মায়। শিশুটি মেয়ে। রাবেয়া তাকে দেখে আঁতকে ওঠে। শিশুটির একটি চোখ নেই। একটি হাতও নেই। মুখটা কলিমুদ্দির মতো বাঁকা। কালো রং, একেবারে কলিমুদ্দির চেহারার গঠন।’ এখানে গল্পকার অত্যন্ত কৌশলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ছবিও এঁকেছেন। নারীলোভী পুরুষ সুযোগ পেলে যে-কোনো নারীকে ভোগ করতে ব্যাকুল হয় বটে, কিন্তু পুরুষের মুখ বাঁকা (কল্পনা ও চিন্তা সরল-সোজা নয় অর্থে) আর তার মুখাবয়ব কালো – সর্বদা অন্ধকারে ঢাকা যেন। তাই গল্পকার যখন লেখেন ‘এ যে এক বিকলাঙ্গ শিশু’, তখন তাঁর বর্ণনার ভেতর দিয়ে হাজার বছরের অসুস্থ সমাজকেই ক্যানভাসে ভেসে উঠতে দেখা যায়। আজকের শিশুই যদি আগামিদিনের কর্ণধার হয়ে থাকে, তাহলে তো ‘নারী’ ও ‘বিকলাঙ্গ’ শিশুর জন্ম দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন পুরুষ মূলত অচল এক সমাজ – নড়বড়ে-নষ্ট এক পৃথিবীই নির্মাণ করে চলেছে অনাদিকাল ধরে! গল্পকারের এই পর্যবেক্ষণ সত্যি ভয়াবহ; বিকট এক সমাজ-কাঠামোকে পাঠকের সামনে হাজির করে। ‘পুরুষ মানুষের খেয়ালি আর আনন্দের শিকার’ নারী যে কখনও তার মর্যাদা ও অধিকার নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি, তা গল্পকার যাপিত-জীবনের অভিজ্ঞতার কুপিবাতির আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেয়েছেন যেন!

‘নিঃশব্দে নিশীথে’ গল্পে স্থান পেয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নারীর অনন্ত নিরব কান্নার ধ্বনি। গল্পকথক উর্মি শৈশবে গভীর রাতে মায়ের যে চাপাকান্নার শব্দ শুনে-শুনে বেড়ে উঠেছে, সেই একই – অনুরূপপ্রায় কান্না তার জীবনেও বাসা বেঁধেছে। এ যেন নারীর জন্য নির্ধারিত এক অভিশাপ। অথচ নারীর জীবন কতো সুন্দর হতে পারতো, পুরুষের একটু সহযোগিতা আর আন্তরিকতা পেলে! উর্মির ভাষ্যে তার আবাসস্থলের একটি চমৎকার-সুন্দর বিবরণ এঁকেছেন গল্পকার তসলিমা হাসান। তিনি কেন এই গল্পে এইরকম এক বর্ণনা জুড়ে দিলেন? ভেবেছেন, একটি সাজানো বাড়ির মতো এমন গোছানো হতে পারতো নারীর সংসার-যাপন! অথবা নারীও যে বাড়ির মতোই কেবল শোভাবর্ধনের বস্তু, তেমন কিছু কি অনুভব করেছেন তিনি? গল্পশিল্পীর চোখে সেই সুন্দরের ছবি দেখা যেতে পারে: ‘ড্রইংরুমটা ছোট। তবে নিখুঁত। সাজানো বেতের সোফা। কাঁচের সেন্টার টেবিল। দু’কোণায় দুটো বাহারি স্ট্যান্ডল্যাম্প। দেওয়ালে খোপখোপ সৌখিন কাঠের র‌্যাক। প্রতিটি র‌্যাকে একটি-দুটো করে চিনেমাটির পুতুল। জানালায় জানালায় পিতলের ফুলদানি। দু’ধারে কাঁচের আলমারিতে বই আর বই। উঁচু ক্যাবিনেটে টিভি আর ইনডোর প্ল্যান্ট। দরজা-জানালায় সাদা পর্দা। বৃত্তাকার মিনি কার্পেট। মেঝে, দেওয়াল, জানালা আসবাব – কোথাও এতটুকু ধুলো নেই। মালিন্য নেই। চারদিক চাপা, আলো কম। ঘরটা নিজের জ্যোতিতেই উজ্জ্বল।’ প্রতিবেশ বর্ণনায় লেখকের মুন্সিয়ানা এবং দীপ্ত প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। নারীকে ঘরের শোভাবর্ধনের বস্তুতে পরিণত করেছে যে সমাজ ও মানুষ, তাদের চোখে ও চেতনায় সামান্য দোলা বা আলোড়ন কি জাগাতে চেয়েছেন তসলিমা তাঁর গল্পকথনের ভেতর দিয়ে? তসলিমা হাসান তাঁর গল্পে পুরুষকে এঁকেছেন ‘নামকরা’, ‘শক্তপোক্ত’, ‘ডিজিজ’বিহীন, ‘বহির্মুখি’, ‘যুক্তাক্ষরবর্জিত জীবনের মালিক’ হিশেবে; ‘যে সুখ পৃথিবীতে নেই, সেই সুখে ভাসে’ তাঁর কাহিনির ‘পুরুষেরা’। তসলিমার গল্পের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো যুতসই উপমা ও প্রতীকের প্রয়োগ। যেমন এই গল্পে, ‘পাল্লা খোলা দরজার মতো ওর বুকের ভেতরটা শুধু হা হা করে’, ‘খরার দিনের সন্ধ্যায় শস্যহীন মাঠের মতো মনটা ওর ধূসর ঝাপসা লাগে’, ‘স্বচ্ছ জলে লুকিয়ে থাকা সকালের মতো’, ‘ঝাঁকড়া একটা মহুয়া গাছের মতো মানুষটিকে’ – এসব উপমা পাঠককে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভাবনার অতলে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

‘সেটেলড’ ম্যারেজে ‘কোনো এক স্বপ্নে বিভোর হয়ে বিয়ে করা’, ‘খেয়ালি মনের’ পুরুষের সাথে মানিয়ে নিতে-না-পারা এক নারীর গল্প ‘অরুণিমার দৌর্মনস্য’। বিত্ত-বৈভব, সামাজিক অবস্থান আর সাংস্কৃতিক রুচিবোধের পার্থক্যের কারণে দাম্পত্য-জীবনে অলক্ষ্যে যে ‘দেয়ালসমান ব্যবধান তৈরি হয়’, তার বাস্তবতা বর্তমান গল্পের শিরায় শিরায় স্থাপন করেছেন তসলিমা হাসান। এই গল্পে উপশিরা হিশেবে স্থান পেয়েছে প্রবাস-জীবন ও স্বদেশের সাথে সম্পর্ক, প্রেম, মোহভঙ্গ এবং অযাচিত অবহেলার ছবি। সাময়িক আবেগ যে স্থায়ী কোনো কষ্টের কারণ হতে পারে, সে পাঠ পাঠক অরুণিমার জীবন থেকে দেখে নিতে পারে খুব সহজেই।

‘জীবনের রূপ’ বদলের গল্প ‘প্রতিশোধ’; এই কাহিনিতে গল্পকার তসলিমা অনেকগুলো বিষয় ও চরিত্রকে তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার ও পাক-বাহিনির অত্যাচার; ধর্ম নিয়ে কুসংস্কারের চর্চা, পানিপড়া-জিনপ্রথায় গ্রামের অশিক্ষিত মানুষের বিশ্বাসকে আশ্রয় করে কৌশলি মানুষের প্রতারণা, প্রতিশোধ, বাল্যবিবাহ, পরকীয়া প্রভৃতি বিষয় হিশেবে এসেছে। আর চরিত্ররূপে প্রবেশ করেছে মুক্তিযোদ্ধা, ভ-পীর ও তার সহযোগী, পরকীয়া প্রেমের নাগর-নাগরী – যারা জীবন-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়, মমতাময়ী মা, আশ্রয়দাতা মামা, ব্যবসায়ী, বন্ধু, খুনি প্রভৃতি। এই গল্পে জীবনের পাপ ও তাপকে লেখক একসুঁতোয় গেঁথে তুলেছেন যেন। পাপ যেমন অবশ্যম্ভাবী, তেমন তা নিবারণের তাপও দরকারি – প্রেম ও প্রতিশোধ কখনও কখনও জীবনের রূপ বদলে দিতে পারে, তা নিবিড়ভাবে বিশ্বাস করেন তসলিমা হাসান। এই উচ্চকণ্ঠ অথচ বিনীত কাহিনি নির্মাতা তাঁর ঔচিত্যবোধের ওপর নির্ভর করে লিখেছেন: ‘তুচ্ছ নীতিবোধের জন্য জীবনকে নষ্ট করতে চায় না দুজন। গোপনীয়তাকে ওরা পাপ মনে করে না। শরীর প্রস্তুত হয়ে যায়। দুজন ঠোঁটে ঠোঁট রাখে।’ দেবর-ভাবি আসাদ-নূরীর সম্পর্কের এই বিবরণের মধ্য দিয়ে গল্পকার তসলিমা কি পাপের অন্তরালে সুপ্ত থাকা ও জেগে ওঠার এক গভীর তাপকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন? এই তাপ কি নারীকে তার অধিকার আর অবস্থান অর্জনের লড়াইয়ে সামনে এগোতে প্রেরণা যোগায়?

নারীবাদী লেখক তসলিমা পুরুষের ইতিবাচক মানসিকতা আবিষ্কার করতে ভুল করেননি; তিনি দেখেছেন কখনও কখনও পুরুষ হয়েছে নারীর প্রবল আশ্রয়ের ঠিকানা। কোনো কোনো পুরুষের দৃষ্টিতে নারী যে ‘পূর্ণ চন্দ্রের মতো অমলিন জ্যোৎস্না, তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তসলিমার ‘রাজেশ্বরীর কুঞ্জ’ গল্পে অরণ্য নামের এমনই এক পুরুষের উপস্থিতি ঘটেছে। রাজেশ্বরীকে বিয়ে করে প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী রাজন প্রবাসে পাড়ি দিয়ে নিখোঁজ হলে অরণ্য তাকে ‘ভালোবাসা’ নামক আশ্রয় দেয়। গল্পে প্রসঙ্গক্রমে এসেছে সন্দেহ, বিশ্বাসঘাতকতা, স্মৃতি, সংকট, প্রত্যাশা, আত্মমর্যাদা, ভালোবাসার শক্তি, স্বপ্ন আর ‘সব জেনেও না জানার ভান করে চুপ করে’ থাকার ব্যাপারাদি। লেখক এক প্রবল সত্যকে অনুভব করেছেন এখানে – জীবনটাকে সব সময় সহজভাবে ভাবা যায় না; জীবনের সমীকরণ নানান সময়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে হাজির হতে পারে। তবে, সবকিছুকে অতিক্রম করে এই গল্পে নারীর জন্য এক ইতিবাচক পুরুষ-চেতনা জাগাতে পেরেছেন গল্পকার। গল্প থেকে খানিকটা পাঠ নেওয়া যেতে পারে: ‘জায়গাটা যেন ওর মনের ভেতরটার মতো শান্ত। পাহাড়ের গায়ে জলের কাছে গাছের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে, ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে? অরণ্যকে অদ্ভূত শীতল লাগছিল ওর কাছে।… অরণ্য একসময় আলিঙ্গন করে বুকের ভেতরে টেনে নিল রাজেশ^রীকে। দুজনে মিলে হাঁটতে থাকে ধীর কদমে, গাছের আড়ালে; তারপর একসময় মিশে যায় সবুজে – অনেক সবুজে।’

তসলিমা হাসানের ‘নির্বাচিত গল্প’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত অন্য গল্পগুলো হলো : ‘মানবজীবন’, ‘গোধূলি’, ‘প্রস্ফুটিতা’, ‘ধর্ষিতা’, ‘নিলামি জীবন’, ‘অসময়ের বসন্ত’, ‘জোনাকি জ¦লে’, ‘আত্মজা’, ‘নিশিথে রুমঝুম’, ‘সুখ-অসুখ’, ‘কপট’, ‘অনুরূপতা’, ‘চোখের মণি’ এবং ‘গোধূলির রং’। এসব গল্পে লেখক তাঁর শৈশব-কৈশোরের কাল, প্রবাস-জীবন, অনুভব করা সংসার-পরিস্থিতি, সামাজিক প্রথা সম্বন্ধে নিজস্ব অভিমত; মানব-মানবীর সম্পর্কের বৈচিত্র্য ও বাস্তবতা, মানুষের হতাশা আর স্বপ্নকে শাদা-কালোর বর্ণনায় স্থান দিতে চেষ্টা করেছেন। অনুভবে তিনি সরল; প্রকাশে অকুণ্ঠ – দ্বিধাহীন।

তসলিমা হাসান কল্পনা আর বাস্তবতাকে গল্পের শরীরে চাদরের মতো যতেœ চাপিয়ে দিয়েছেন। কেউ যদি একবারও সে-চাদরটা সরিয়ে চোখ বুলাতে চায় সমাজের নিকট শরীরে, অবশ্যই দেখতে পাবে – উদোম গায়ে কালো কালো ছোপ ছোপ দাগ! তসলিমার গল্পগুলোতে কষ্টের কথা আছে; আছে আনন্দ-আভাসও। প্রবল ভগ্নদশার ভেতরেও তিনি আশাবাদকে লালন করেছেন প্রকৃত শিল্পীর মন নিয়ে। তিনি যেমন পাপের সরল বিবরণে সূক্ষœবোধসম্পন্ন, তেমনই প্রতিবাদী-চেতনার তাপ সৃষ্টি করতেও সিদ্ধহস্ত।

সম্পর্কিত খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আবুল খায়ের 

নির্বাহী সম্পাদক: 
বার্তা প্রধান:

অফিস: বাড়ি ০৭, সড়ক ১৪/সি, সেক্টর ৪,

উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।

যোগাযোগ: ০১৭১৫৩৬৩০৭৯

বিজ্ঞাপন: ০১৮২৬৩৯৫৫৪৯

Email: khair.hrm@gmail.com

info@dainikprotibimbo.com

protibimboprokash.com

Facebook

©2025 Dainik Protibimbo – All Right Reserved. Designed and Developed by Bangla Webs