দেয়ালঘড়ি ও একটি নিঃসঙ্গ বিকেল। ছোটগল্প। রোখসানা ইয়াসমিন মণি

by protibimbo
০ মন্তব্য ৮৯ বার পড়া হয়েছে

দেয়ালঘড়ি ও একটি নিঃসঙ্গ বিকেল। ছোটগল্প। রোখসানা ইয়াসমিন মণি

​আব্দুল করিম সাহেব তেইশ বছর ধরে একই চেয়ারে বসে আছেন। তার টেবিলের উপর একটি পুরোনো দেয়ালঘড়ি, যার পেণ্ডুলামটা অত্যন্ত ধীর গতিতে নড়ছে। ঘড়িটার টিক্ টিক্ শব্দটা এই বিশাল সরকারি লাইব্রেরির নিঃশব্দতায় এক অদ্ভুত শূন্যতার সৃষ্টি করে।
​করিম সাহেব লাইব্রেরিয়ান। কিন্তু তিনি বইয়ের ধুলো ঝেড়ে, বই সাজিয়ে, কার্ড পাঞ্চ করেই জীবন কাটাননি। তিনি বইয়ের গন্ধ নিতেন,পড়তেন আর প্রতিটি গল্পের চরিত্রদের নিজের জীবনের অংশ করে তুলতেন।
​তাঁর জীবনের একমাত্র সত্য ছিল—একা থাকা। চল্লিশ বছর আগে তাঁর স্ত্রী একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। তারপর থেকে করিম সাহেব লাইব্রেরির তাকে তাকে নিজের জীবনকে খুঁজে ফিরেছেন। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না।
​আজ বিকেলটা বড়ই বিষণ্ণ। বাইরে কুয়াশার মতো হালকা বৃষ্টি পড়ছে। লাইব্রেরি প্রায় ফাঁকা। শুধু কোনার টেবিলটায় একটি মেয়ে বসে আছে। মেয়েটির নাম অহনা। লম্বা বেণী, আর চোখে কাজল। সে সাধারণত হুমায়ূন আহমেদের বইগুলোই খোঁজে।
​কিছুক্ষণ পর অহনা উঠে এসে করিম সাহেবের টেবিলের সামনে দাঁড়াল। হাতে একটি বই, নাম—’হিমু’।
​”করিম আঙ্কেল,” অহনা ছোট করে বলল, “হিমু কেন সবসময় একা থাকতে ভালোবাসে?”
​করিম সাহেব চশমাটা নামিয়ে রাখলেন। তাঁর চোখ দুটো ক্লান্ত, ঠিক যেন বহু দূরের পথ হেঁটে আসা কোনো পথিক।
​”হিমু একা থাকতে ভালোবাসে না, মা,” তিনি মৃদু হেসে উত্তর দিলেন। “হিমু আসলে মানুষের মুখোশগুলো দেখতে পায়। আর সেই মুখোশের আড়ালের শূন্যতা যখন সে দেখতে পায়, তখন সে আর মানুষগুলোর কাছে যেতে পারে না। তাই সে দূরে দূরে হাঁটে, যেন সেই শূন্যতা তাকে স্পর্শ না করে।”
​অহনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “আমারও মাঝে মাঝে এমন মনে হয়। সবাই হাসছে, কথা বলছে, কিন্তু ভেতরে কেমন যেন একটা গুমোট কষ্ট। একটা দেয়াল। সেই দেয়ালটা কেউ ভাঙতে পারে না।”
​করিম সাহেব তাঁর টেবিলের দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকালেন। ঘড়িটার কাঁচের ভেতর দিয়ে পেণ্ডুলামের ধীর চলনটা দেখা যাচ্ছিল।
​”দেয়াল,” করিম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আমরা সবাই এক একটা দেয়াল তৈরি করে ফেলি, অহনা। আমার দেয়ালটা আমার স্ত্রী মারা যাওয়ার দিন তৈরি হয়েছিল। তার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল একটা সাধারণ বিষয় নিয়ে—কোন রঙের শাড়ি পরা হবে আজ। সেদিন বিকেলে আমি তার জন্য সেই শাড়িটা নিয়ে ফিরেছিলাম, কিন্তু তাকে আর ফেরত পাইনি। সেই থেকে আমার ভেতরে কেবলই এই প্রশ্নটা ঘোরে—আমি কি তাকে শেষবারের মতো ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলতে পারতাম না?”
​তিনি থামলেন। তাঁর চোখ ভরে এলো।
​”আমার ঘড়িটা সেই দিনের সময় থেকে যেন আর এগোচ্ছে না। শুধু টিক্ টিক্ করে একটাই কথা বলছে সময় চলে গেছে, করিম। সময়টা আর ফিরবে না’।”
​অহনা চুপ করে করিম সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখও ছলছল করছে। সে বুঝতে পারে, এই প্রবীণ মানুষটি একা নন, তিনি আসলে বহু পুরোনো, অপূর্ণ ইচ্ছেদের নিয়ে বেঁচে আছেন।
​অহনা ধীরে ধীরে হিমুর বইটি করিম সাহেবের টেবিলের উপর রেখে দিল।
​”আঙ্কেল, হিমু এত হাঁটে।একসময় হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয় না?”
​করিম সাহেব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। সেই হাসিটা ছিল বিষাদের মোড়কে ঢাকা।
​”হয়, মা। খুব ক্লান্ত হয়। তারপর সে একটা পুরোনো লাইব্রেরিতে ফিরে আসে, যেখানে একটা ধীরগতির দেয়ালঘড়ি আর একাকী একজন লাইব্রেরিয়ান বসে থাকে। কারণ, জীবনের পথে হাঁটতে হাঁটতে সে বুঝতে পারে—সবচেয়ে বড় রহস্যটা মানুষের একাকীত্বের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে।”
​বাইরে বৃষ্টি থেমে আসে। কিন্তু লাইব্রেরির ভেতরে সেই দেয়ালঘড়ির টিক্ টিক্ শব্দ আর করিম সাহেবের নীরব বিষাদ, যেন এক অনন্ত বিকেলের গল্প লিখে চলে।

সম্পর্কিত খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আবুল খায়ের 

নির্বাহী সম্পাদক: 
বার্তা প্রধান:

অফিস: বাড়ি ০৭, সড়ক ১৪/সি, সেক্টর ৪,

উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।

যোগাযোগ: ০১৭১৫৩৬৩০৭৯

বিজ্ঞাপন: ০১৮২৬৩৯৫৫৪৯

Email: khair.hrm@gmail.com

info@dainikprotibimbo.com

protibimboprokash.com

Facebook

©2025 Dainik Protibimbo – All Right Reserved. Designed and Developed by Bangla Webs