গোলাম কিবরিয়া পিনুর কবিতা : প্রসঙ্গ বিষয়-ভাবনা। বাবলু জোয়ারদার

সাহিত্য আলোচনা

by protibimbo
০ মন্তব্য ৫৫ বার পড়া হয়েছে
গোলাম কিবরিয়া পিনুর কবিতা : প্রসঙ্গ বিষয়-ভাবনা
বাবলু জোয়ারদার
———————————————
কবিতার শব্দশৈলীতে আত্মমগ্ন একজন শুদ্ধাচারী কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু। মন মননে চলনে বলনে জীবনাচারে তিনি একজন শুদ্ধচারী মানুষও বটে। নিয়ত কবিতার সাথে তাঁর বসবাস। সুদীর্ঘ সময় তাঁর কবিতার সাথে সখ্য কিংবা কবিতার আলোয় জীবনযাপন। শব্দ ছেনেছেনে কবিতার শরীর গঠনে সুনিপুণ কারিগর তিনি। আশির দশকের এই কবি আজ আরো বেশি শাণিত আপন শৈলীতে। বিষয় প্রকরণেও তিনি নিরন্তর নিরীক্ষার ভেতর পথ হাঁটেন। বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা দারিদ্র্যতা শোষণ-বঞ্চনা যুদ্ধ আর পতনোন্মুখ নৈতিকতায় কবি ভীষণ ক্ষুব্ধ। তা বলে তিনি হতাশ নন। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর তিনি দিব্যদৃষ্টি পেয়ে আত্মজ্ঞানে বলীয়ান হয়ে উঠেন। এঁদো পুকুরের জল থেকে অতলান্তিক জলের উৎসে ফিরে এসে তিনি গভীরতা খোঁজেন চেতনার। এ যেন তাঁর পুনরুত্থান! তল-অতলস্পর্শী কবিতার শক্তিতে তিনি জাগরণ ঘটাতে চান সমাজের মানুষে-মানুষে হৃদয়ে হৃদয়ে। সূর্যভোর প্রত্যাশায় তিনি পথ হাঁটেন কবিতার অনিরুদ্ধ আলোয়। কবি পিনু শিল্পিত উচ্চারণে কখনো দ্রোহের কথা বলেন, কখনো দেশ প্রেমের গান শোনান দৃপ্ত কণ্ঠে। মাটির সোঁদা গন্ধ মেখে কবিতায় ঋদ্ধ হন দেশজ প্রেমে। জলের উদারতা নিয়ে তার ভেতর জেগে উঠে কবিতার শক্তিতে মহাপ্রাণ। মাটির সোঁদা গন্ধ মাখা মমত্ব তাঁর কবিতার ছত্রে-ছত্রে প্রকৃতির বৃষ্টিধারা যেন। কবিতা মানুষ আর প্রকৃতির প্রতি এভাবেই অনুগত কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু। সহজাত কবি প্রতিভায় ভাস্বর কবি এগিয়ে চলেন এক দোয়েল পাখির গানের সবুজ আঙিনায়। কবি যেমন দ্রোহের আগুন ছুঁড়ে দেন, তেমনি তিনি সূর্যভোর প্রত্যাশায় বুনে দেন স্বপ্নের বীজ আলোড়িত পাঠক হৃদয়ে।
কবি গোলাম কিবরিয়া পিনুর কবিতার কতিপয় দিক নিয়ে এ আলোচনার সূত্রপাত। আমরা পিনুর কবিতাকে তিন ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা শুরু করতে পারি।
ক. রাজনীতি ও স্বদেশপ্রেম
খ. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
গ. জীবনবোধ
ক. রাজনীতি ও স্বদেশপ্রেম
——————————-
পিনুর কবিতায় প্রবলভাবে আছে রাজনীতি ও স্বদেশপ্রেম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশমাতৃকার জন্য অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করা এই মুক্তিযোদ্ধা কবি নিজের বুকের ভেতর বহন করে চলেন দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দিলে মুক্তিযোদ্ধা কবি পিনু আত্মযন্ত্রণায় রাজনীতির নষ্ট খেলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন কবিতায়। গণমানুষের দাবির প্রতি একাত্ব হয়ে কবিতা লেখেন তিনি, জনতার সংঘ-শক্তিতে বিশ্বাসী হয়ে তাদের জ্বলে ওঠার প্রতীক্ষায় থাকেন। তিনি তাঁর কবিতায় রাজনীতির কূটভাষ্য আর কূটচাল তুলে এনে দাঁড় করান জনতার আদালতে। দেশাত্ববোধে জারিত পরিশীলিত রাজনীতির স্বপ্ন লালন করে তিনি পথ হাঁটেন সামনে। আর তাই সমসাময়িক রাজনীতির স্বপ্ন লালন করে তিনি পথ হাঁটেন। সমকালের রাজনীতির কূটভাষ্যে ব্যথিত হয়ে তিনি কবিতায় ধিক্কার জানান। দেশপ্রেমের আকাল দেখে জনতার সংঘ-শক্তির উত্থান কামনা করেন তাঁর কবিতায়। পিনুর কবিতায় রাজনীতি ও দেশপ্রেমের প্রাবল্য সহজেই লক্ষণীয়, তবে তা কখনো শ্লোগানধর্মী নয়। মুনাফালোভী সাম্রাজ্যবাদের নগ্নচরিত্র তিনি তুলে এনেছেন কবিতায় সুনিপুণ প্রকৌশলে। রাজনীতির আঁতুর ঘর থেকে উঠোনের হানাহানি আর রাজনৈতিকদের দেশপ্রেমহীনতা পিনুর কবিতায় নান্দনিকভাবেই উপস্থিত।
বৈচিত্র্যহীন গতানুগতিক এক ছাপোষা কষ্টের জীবন। হালের বলদের মতো ক্রমাগত জাবরকাটা। না আছে স্বপ্নের সাতরঙ রঙধনু, না আছে বৃক্ষবেলার পাখির গান। না আছে ভালোবাসার সবুজ সখ্যমাখা এক চিলতে সোনালি রোদ। অন্ন যোগাতে ওষ্ঠাগত প্রাণ, হারিয়ে গেছে কৈশোর পেরুনো উচ্ছলতা, স্বপ্নের রঙিন দিনগুলি। কুলুর বলদের মতো কেবলই ঘুরপাক। বলদের মতো জাবর কাটতে-কাটতে হারিয়ে গেছে বীজ ছড়ানোর স্পর্ধা। নষ্ট হয়েছে জীবন-মন-মননের সকল সৌন্দর্য। অক্ষমতার অচলায়তনে অবরুদ্ধ মধ্যবিত্তজীবন। সখ আর সুখ বারুদ গন্ধে পলাতক পাখির মতো নিরুদ্দেশ। নিরুদ্বিগ্ন পাখির মতো রৌদ্রগন্ধ মাখা হয় নি কখনো। হাজারো সাধের এক চিলতে রেশমি কাপড় জোটে নি পোড়া কপালে, এমনকি ছাপা সুতির কাপড়। সংকীর্ণতা আর নানান সীমাবদ্ধতায় ঘেরা টোপে আবদ্ধ এ জীবন। মধ্যবিত্ত মানসিকতায় আমরা হারিয়ে ফেলেছি মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি। স্বপ্নহীন কোনো মোহের ক্লেদাক্ত জীবনে আমরা পড়ে আছি? আর এই মধ্যবিত্ত মানসিকতা থেকেই কল্পিত সুখের জন্য কবি এক ব্রতচারিণী বালিকার কাছে মিনতি করেন কৈশোরোত্তীর্ণ সময়ের উচ্ছলতা ফিরে পাওয়ার জন্য। কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু সময়ের প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্ত সমাজ-মানসের বাস্তবানুগ পরিস্ফুটন ঘটিয়েছেন কবিতায়। পাঠক তাঁর কবিতার শব্দশৈলীর অন্তরালে মধ্যবিত্ত সমাজ-মানসের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাবেন এবং নিবিষ্ট হবেন কাব্যিকতায় :
ছাপা সুতি বা রেশমি কাপড় পরতে পারি নি
এক জাতের গাছের নিচে পড়ে আছি
পেঁচিয়ে বাঁধানো জীবনটা কোন্ ঘরের ছাদের তলে ?
গ্রীবা তুলে তাকাতে পারি না।১
আজ রোদপোড়া কষ্ট মানুষের। রোদের আগুনে পুড়তে থাকা ইট ও পাথরের মতো নির্জীব মানুষ। দুঃসময়ের নষ্ট আয়োজনে আজ দুঃখের অধিবাস মানুষের বুকের ভেতর। নিঃশব্দ যন্ত্রণার বেড়ি পড়ে কোন্ বেলাভূমে হেঁটে যায় মানুষ? অথচ জল স্পর্শের তীব্র ও আকুল আকাক্সক্ষার ত্রিমাত্রিক দুঃখ ছড়িয়ে পড়ে চরাচরব্যাপী। জীবনের প্রচ্ছদ ভেঙে দিতে আয়ন মÐলের দানবেরা রোদের আগুন ছুঁড়ে দেয়। অথচ তা থেকে বাঁচার শিরস্ত্রাণ নেই। কেমন করে মানুষ বৃক্ষছায়ার কাছে যাবে? পায়ের সাথে পা বাঁধা, পরাভূত জীবনে কোনো রঙ থাকে না, উত্তোলিত হয় না মুষ্টিবদ্ধ হাত। শুধুই ব্যর্থ জীবনের ভার বহন করে চলা বলদের মতো। অন্ধকারের মাধ্যাকর্ষীয় বল টেনে নেয় আরো গভীর অন্ধকারের ভেতর। এই উপদ্রুত উপকূলে দুর্গত সময়ের অন্ধকারে মানুষ ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছে। দুঃখের শরীরে উদগত কান্না দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। অসহায় আর্ত চিৎকারে বিদীর্ণ আকাশ-বাতাস। প্রলম্বিত অন্ধকারের ভেতর আজ সময় নিয়ন্ত্রণ করছে শিকারি কুকুরেরা। মানুষের অসহায় বিষাদে ক্লান্ত বোধের ঘুম-ঘুম সময়। কুহক লাগা এই সময়ের বিভ্রম থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য কবির কাব্যিক আহ্বান :
শুভ-শুভ্রতার কত উদিত সকাল
তাড়িয়ে তাড়িয়ে ফেলে দেয় অন্ধকারে,
নিরীহ ছায়ার ভেতর নিরীহ মানুষেরা আজ
গোঙায় গোঙায়।২
শস্য-শ্যামল বাংলার মানুষের আজ দুঃখাক্রান্ত উদ্গত কান্নার ভেতর বসবাস। সবুজপ্রান্তর ফসলের মাঠ অঙ্কুরিত দুঃখ নিয়ে পড়ে থাকে উদ্বিগ্ন শয্যায়। খোলা বাজার অর্থনীতির নামে চলছে ভিন্ন ধরনের দস্যুতা। কৃষকের গোলা থেকে আজ সবকিছু লুট হয়ে যায়। গলদা চিংড়ি, নদীর ইলিশ, তরতাজা যৌবনময়ী সবজি সবকিছু নিয়ে যায় খোলা বাজারের বারোভূত, অথচ দুঃখ নেয় না কেউ! এমনকি দুঃখ বর্ণনাও শুনতে চায় না কেউ। কবি এজন্য ভীষণ ক্ষুব্ধ, ব্যথিত। মনোবেদনা আর দুঃখের বারমাস কবির দিনপঞ্জিতে। খোলা বাজার অর্থনীতির চকচকে মুদ্রালোভে লুটেরা আবার এসেছে এদেশে ফিরিঙ্গিদের মতো। অসহনীয় দুর্ভোগ এ জাতির কপালে যেন এঁকে দিয়েছে কলঙ্ক তিলক। তাইতো বার-বার ফিরে-ফিরে আসে পুরনো দুর্ভোগ। আর সাথে-সাথে নেচে-নেচে ওঠে আকণ্ঠ দারিদ্র্যতায় নিমজ্জিত জাতির সামনে নানাবিধ সংকট। ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে এ ভূখণ্ডের মানুষের সকল গৌরব-ঐতিহ্য। ক্রমাগত ঘনীভূত হতে থাকা অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে থাকে মানুষ। কবি আতঙ্কিত ক্রমাপসারমান অন্ধকারের ঘনত্বে! তাই মেঘের কাছে কবির প্রার্থনা: ‘ওগো মেঘ দুরের আকাশে নিয়ে যাও।’ কবি যেতে চান নক্ষত্রের আলোয় উদ্ভাসিত উদার নীল আকাশের কাছে, যেখানে কোনো দস্যুতা নেই :
বীজের বদলে দুঃখ অঙ্কুরিত হয়
ফসলের মাঠে,
খোলা বাজারের নামে বারভূতে নিয়ে যায়
গল্দা চিংড়ি
নদীর ইলিশ
এমন কি সবচাইতে যৌবনময়ী সবজী।৩
আজো আমরা ঋজু ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারি নি। আজো আমরা দেশপ্রেমে ঋদ্ধ হয়ে এই জল-মাটি হাওয়ায় পরিপুষ্ট গণতন্ত্রের বাতাবরণ সৃষ্টি করতে পারি নি। এখানে গণতন্ত্রের নামে চলছে এক মায়াবী জাল বিস্তার করে শোষণের পাঠ পরিক্রমা। যদিও এখনো তা খুব একটা দৃশ্যমান নয়। এই পরিবর্তনশীলতা চলছে একান্ত অন্তপুরে। যখন তা পূর্ণতা পাবে ও দৃশ্যমান হয়ে উঠবে, তখন তা হয়ে উঠবে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর! এবং শোষণের পাঠ-পরিক্রমার পূর্ণতা আনার জন্য আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের চরিত্র হনন চলছে প্রতিনিয়ত। কিংবা নেতারা চরিত্র বিক্রির প্রতিযোগিতায় নেমেছেন মহাহুল্লোরে। এই জনপদে গণতন্ত্র নামের সোনার হরিণ গণমানুষের কাছে নেই, আছে ভিন্ন পকেটে। গণতন্ত্রের নামে আজ আমাদের নছিয়ত করে বিদেশি পণ্ডিত আর তাদের এদেশীয় দালালেরা। তারাই নেপথ্যে আমাদের এই দেশ শাসন করে শোষণ করে। মানবীর বেশে এসে মায়াবী কথায় ভুলিয়ে তারা আমাদের বশে রাখে। কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়িয়ে তাঁরা পরিবর্তন করে দেয় আমাদের জলবায়ু। তাদের শোষণ প্রক্রিয়ার কারণে আমরা বঞ্চিত হই স্বাভাবিক বায়ুপ্রবাহ থেকে, এমনকি আমাদের বর্ষার স্বাভাবিক চরিত্রও হারিয়ে গেছে। অথচ এখনো আমাদের বিস্ময়বোধ জাগে না! আমরা এখনো তাদের মায়াবী ছলনায় মোহাবিষ্ট! কবির অন্তর্দৃষ্টির নক্ষত্র আলোয় তাঁর কবিতা আলোকিত। যেমন :
গণতন্ত্রের সুরমর্ছনা কারা উপভোগ করে :
কারা সাজিয়ে তোলে আমাদের ?
বিস্ময় বোধ জাগেনা এখনো!৪
এ জাতির বলবীর্যের ইতিহাস অতিপ্রাচীন। বিশ্বব্যাপী আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস পাঠ করলে কিংবা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বাঙালি জাতির অবস্থান সামনের দিকেই আছে। প্রায় দুইশ বছরের পরাধীন ভারতবর্ষে বৃটিশ সম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে বাঙালি অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। সে সময় আন্দোলনের নেতা কর্মীদের কালাপানি নামে খ্যাত আন্দামানে পাঠানো হতো নির্বাসনে। চারিদিকে সমুদ্র ঘেরা আন্দামান থেকে কেউ পালাতে পারত না। অনেকে সে সময় আন্দামানেই প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের সেইসব বীর পূর্ব-পুরুষের শৌর্যবীর্যের কথা অত্যন্ত নান্দনিক ভাবে তুলে এনেছেন, কবি তাঁর কবিতায়। শস্য শ্যামল প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের ভাণ্ডার এ বাংলাদেশ। এ মাটির সন্তানেরা সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। দ্বীপান্তর খাটা পূর্ব-পুরুষেরা ফসিল ফুয়েলে জ্বলতে জ্বলতে আবার ফিরে এসেছে এই বাংলায়। ঋজুপ্রকৃতির ভেতর অর্থাৎ সরল অন্তরে তাঁদের নেচে ওঠে প্রফুল্লতা প্রসন্নতা। সরল অন্তরে আমাদের নদীও তৈরি করে অনুগমনের দ্যুতি। আমাদের অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বহু কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা এসেছে পূর্ব-পুরুষদের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়। এ স্বাধীনতা কপটতাহীন গন্ধ-পুষ্প নিয়ে এসেছে। এসেছে লাবণ্য ও সুষমায় ভরা রূপ মাধুর্যের চূঁড়ায় চঁূড়ায়। আর বাংলার রূপ মাধুর্য ইউরেনিয়ামের খনির মতো সমৃদ্ধ। তাই কবির যেন দিব্যোন্মাদ অবস্থা। এ এক অনুপম কবিতার নান্দনিক উপস্থাপন :
দ্বীপান্তর ও কালাপানির নির্বাসন থেকে চলে আসি
এখনো মরেনি! ফসিলফুয়েল হয়ে জ্বলি
দেখোÑ এই আলো চেনা যায় কিনা?৫
না, ফাঁদে আটকানো যায় নি। সাম্রাজ্যবাদের তর্পুণে বারবার বিদ্ধ হয়েছে এ জাতি, তবুও তাকে আটকানো যায় নি ফাঁদে। ঋজু ভঙিমায় উদ্দীপ্ত এ জাতি এখনো সক্রিয় তার নিজস্ব সজীবতা নিয়ে। নিজের কৃষ্টি-ঐতিহ্য পরিত্যাগ করে নি, সাম্রাজ্যবাদের লোভের ফাঁদে পা দিয়ে ভুল পথে হাঁটে নি কখনো। শোষণ-বঞ্চনা আর পরাধীনতার অভিশাপ পুড়িয়েছে দ্রোহের আগুনে। লোভের ফাঁদে আটকা পড়ে নি কখনো। অন্যের চকচকে বিলাসী জীবনের লোভে প্রলুব্ধ হয় নি। দ্রæতই উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ–এরকম মায়াবী আহবানে প্রলুব্ধ না হয়ে হেঁটেছে নিজস্ব কৃষ্টি ঐতিহ্যের সরল রেখায়। নিজের সত্তাকে বিসর্জন দেয় নি। বারবার পরাধীনতার পাষাণভার বুকে নিয়ে এ জাতি অন্বেষক আলোয় খুঁজে নিয়েছে নিজের চলার পথ। এখানে আছে ঐক্য, সহমর্মিতার সোহাগী বাতাবরণ। তাই প্রকৃতি এখানে উদার। এখানে নদনদী পরস্পর যুক্ত হয়ে এগিয়ে চলে আর পলি ছুঁড়ে দেয় মানুষের স্বপ্নের পথে। তাইতো হাজার যন্ত্রণা ও বেদনা সয়েও এ জাতির নৈতিকতা আজো ঝুলে পড়ে নি। সবুজ বৃক্ষের সজীবতায় কবি পিনু জাতিকে উদ্ভাসিত করেন তাঁর কবিতায়। যেমন :
কষ্টিপাথরে বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের
প্রয়োজন হয় নি,
কী এক প্রেষণা–
পরিশুদ্ধি এনে দিয়েছিল শত্রু তাড়ানোর যুদ্ধে
যা আজও আমাদের চরিত্রের জোর!
সেই জোর ভোর এনে দিতে পারে আবারও–
এই ফুসলানো অন্ধকারে।৬
সমুদ্রের ঢেউ-এর মতো অমিত তেজের সাধনা কবির আছে। অগণিত মানুষের সেই স্পর্ধা আছে। দ্রোহের আগুনে পোড়া এদেশের মানুষের উপর কবির আস্থা পরিপূর্ণ তা বুঝা যায় এ কবিতা পাঠে। মানুষের জেগে উঠবার প্রতীক্ষায় থাকেন কবি। বিদ্যমান বৈষম্য, শোষণ আর গণতন্ত্রহীনতায় কবি ভীষণ ক্ষুদ্ধ। তথাকথিত খোলাবাজার অর্থনীতির অবাধ লুটপাট, দেশজ ঐতিহ্য ভুলে চকচকে লোভের মুদ্রায় নৈতিকতাবিহীন মানুষের আত্মসমর্পণ, নষ্ট প্রবৃত্তি সম্পন্ন মানুষের আস্ফালন তৈরি করেছে মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব সংকট। আর এসব দেখে কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু তাঁর কবিতায় জ্বেলে দেন দ্রোহের আগুন। কবির নিজস্ব শব্দশৈলীর গুণে সে আগুন পাঠকের মনে সংক্রমিত হলেও কাব্যিকতা নষ্ট হয় না এতটুকু। কবি মানুষের সংঘশক্তিতে বিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন এদেশের মানুষ জেগে উঠবে। আর তাই তাঁর গ্রন্থে বাঙালির কৃষ্টি, ঐতিহ্য যেমন তিনি তুলে এনেছেন, তেমনি বলবীর্য মাখা পূর্ব-পুরুষের সংগ্রামের কাব্যিক উপস্থাপন করেছেন। আবার ফেলে আসা জীবনের সোনাঝরা স্মৃতিময় দিনের সাথে পাঠককে একসূত্রে গেঁথে নেন। কবি তাঁর বহুমাত্রিক চিন্তা ও বোধের পলিমাটি স্বপ্নে আবিষ্ট করেন পাঠককে। ‘জেগে উঠবার জন্য বাদ্য বাজানোর দরকার নেই’।৭
চারদিকে আজ বিরূপ সময়ের ভেতর মানুষের বসবাস। আর এই বিরূপ সময়ের বন্দীত্ব নিয়ে কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু খুঁজে ফেরেন নতুন পথের দিশা। জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রত্যাশা করেন নতুন পথের অনিরুদ্ধ আলো। জল এবং জলপদ্মের কাছে কবির প্রার্থনা নতুন দিনের, যে দিনের সূচিপত্রে থাকবে মানবিকতার জয়গান। বৃষ্টিভেজা দিনের মগ্নতার ভেতর কবি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন নতুন বীজতলার। যেখানে অঙ্কুরোদ্গম হবে বঞ্চনা-বিরুদ্ধ দিনের ভিন্ন এক বিস্ময়ে! অগ্নিদগ্ধ জীবাশ্ম আর মুমূর্ষু মানুষেরা প্রাণ ফিরে পাক জলের অন্বয়ে এই প্রার্থনায় পথ হাঁটেন কবি পিনু। শোষণ-বঞ্চনা আর খরা মগ্নতার উৎস-উন্মূল করে দিতে জল স্রোতের কাছে কবি পিনুর হৃদয় উৎসারিত আহŸান। কবি অপেক্ষায় থাকেন নতুন বিস্ময়ের :
এসো–জলশক্তিতে আমরা জেগে উঠি
কাঠ কয়লার আগুন–বনের আগুন
তুষের আগুন নেভাই– নেভাই দাবানল
শুনি– জলশব্দ কলকল,
মৃত্তিকা ভিজে থাকুক।৮
জলের অন্বয়ে জীবন গড়ে উঠলেও বানভাসি জল কার সহ্য হয় কতটা সহ্য হয়? বানভাসি জল ডুবায় ভাসায়, গভীর মমতায় গড়ে তোলা সংসার ভেঙেচুরে দেয়। তখন কষ্টের লোনাজলের ভেতর বাড়তে থাকে মহাজনী দেনা। অনাহার ক্লিষ্টতার ভেতর রুদ্র আকাশ সন্ত্রস্ত করে। বাস্তুভিটার শেকড় উন্মূল করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বানভাসি জল আতঙ্কের ভেতর। এবং বানভাসি জলের মতোই আজ বিরুদ্ধ হাওয়াই ভেসে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে এই বদ্বীপবাসীর জীবন। এ জীবন কতটা সহ্যের কতটা ধার্যের? আর কতটা নিমজ্জিত হলে মানুষ ফুঁসে উঠবে জল জোয়ারের মতো? মানুষের অবিনাশী শক্তিতে বিশ্বাসী সমাজ মনস্ক কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু মানুষের জেগে উঠবার প্রতীক্ষায় থাকেন। মানুষের চেতনার গভীরে অনুরণন তুলে জলের অন্বয়ে কবি নান্দনিক শব্দমালায় গড়ে তোলেন কবিতার শরীর। উৎপ্রেক্ষা আর চিত্রকল্পের সমন্বয়ে গড়ে তোলা কবিতার জগতে কবি পাঠককে আবিষ্ট করতে সক্ষম হন। যেমন :
ষাঁড়াষাড়ির বান আজ কার গান গায় ?
হাঁটুজল ও কোমরজল সহ্য করা যায়
তবে গলাজল কতক্ষণ ?
বন্যাগ্রস্ত মানে ঋণগ্রস্ত–
বাঁধের উপর ঠাঁই,
বন্যাপীড়িত হবার পর–কই যাই ?
রিলিফের জন্য জলভাঙা সহ্য হয় না ?৯
না, বৃষ্টি নেই। ঘন ঘন মেঘ গর্জন, মেঘের গর্জন শুনতে-শুনতে দিনের পর দিন চলে যায়, অবিরত প্রতীক্ষায় কাটে প্রহর। তথাপি বৃষ্টির দেখা নেই, জলাবনত মেঘের দেখা নেই, জলবর্ষণ নেই। অনবরত মেঘডাক শুনতে-শুনতে কেটে যায় আটপৌরে জীবন। বৃষ্টিহীনতার ভেতর রিক্ত জীবনের প্রচ্ছদে কেবলই হতাশার জাল বোনা হয়। কিন্তু কবি পিনু বৃষ্টির প্রতীক্ষার মতোই মানুষের জ্বলে উঠবার প্রতীক্ষায় থাকেন। মেঘসজ্জা একদিন কব্জা করে আনবে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের অবিরল বর্ষণ। ঠিক সে রকম নক্ষত্রদিনের বার্তা নিয়ে আসবে তেজোদ্দীপ্ত কৌশলী নেতৃত্ব। সব হারানো রিক্ত মানুষেরা জলের অন্বয়ে, ভালোবাসার অন্বয়ে গড়ে তুলবে এক নতুন জীবন। ঠিক যেমন নতুন জলের সোহাগে ভরে ওঠে সোনালি ফসলের মাঠ। কবি পিনু রিক্ত মানুষের সেই আকাক্সক্ষার বীজ বুনে দেন চিত্রকল্পের ভেতর কবিতার ছত্রেছত্রে :
ও বৃষ্টিধারা ও বারিপাত
হাহাকার নিয়ে
তোমার অপেক্ষায় বহুদিন
এ শ্রাবণের রাত।১০
ঘূর্ণিজলের অনিষ্টে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। ঘূর্ণিজলের দুক‚ল ভাঙা প্লাবনে বানভাসি হয় মানুষ। আর বানভাসি মানুষ খুঁজে ফেরে আশ্রয়ের চারণভূমি। নদীমাতৃক এই দেশে নিয়ত ঘটছে এমন ঘটনা। কিন্তু মানুষের এই করুণ দুর্দশা কতটুকু ছুঁয়ে যায় আমাদের হৃদয়? নানা মাত্রিক জটিলতায় এ ভূমির নদী উপত্যকার সহজ সরল মানুষ এমনিতেই অসহায়। তার উপর জলের অনিষ্টে দুকূল ভাঙা প্লাবনে বানভাসি হয়ে কেবলই খড়কুটো হয়ে ভাসতে থাকে–হারিয়ে ফেলে বুকের ভেতর আস্থার জমিন। উন্মূল এই মানুষের জীবনে অস্তিত্বের শেকড়ে টান পড়ে। মানুষ হয়ে পড়ে সর্বহারা। কবি পিনু সেই সর্বহারা মানুষের অসহায় জীবনালেখ্য তুলে এনেছেন অনুভবে-উৎপ্রেক্ষায় মনোরম চিত্রকল্পে। নান্দনিক শব্দমালায় বানভাসি মানুষের কষ্টের উপাখ্যান যেন এ কবিতাটি। কবি পিনু বানভাসি মানুষের কষ্ট ছেনে ছেনে বানিয়েছেন কবিতার বিষয়-আশয় :
দুকূলভাঙা প্লাবনে
বানভাসি হয়ে কোন্খানে আসি?
পাঁকের ভেতর পড়ে গিয়ে কাদামাখা হয়ে
এবারও কি চারণভূমির খোঁজ পাবো না ?
ঘোর বর্ষণের কালে অঝোর ধারায় কেঁদে কেঁদে
দুঃখক্লিষ্ট হয়ে বন্যাপীড়িত হয়ে
আবারও ঘূর্ণিজলে খড়কুটো হয়ে ভেসে যাবো?১১
এই দেশে পণ্যজীবীরা যখন তখন পণ্যমূল্য বাড়িয়ে বিবর্ণ করে দেয় মানুষের কষ্টক্লিষ্ট জীবন। মুনাফা লোভীদের পণ্যমূল্য বাড়াতে কোনো অজুহাত প্রয়োজন পড়ে না। আর যদি উদাস ঘনকালো মেঘ অনবরত বর্ষণে মগ্ন থাকে, তাহলে তো কথাই নেই! বর্ষণের দুর্দিনে তারা জনজীবন ভাসিয়ে দেয় পণ্যমূল্যের তোড়ে। লোভের রোগাক্রান্ত সময়ের ভেতর বাড়তে থাকে রোগ বালাই। সবুজ সতেজ সবজি ও মুনাফার লোভে আজ বিষাক্রান্ত। বিশ্বলুটেরা, তাদের দোসররা আমাদের ঔষধি লতাগুল্মও দখলে নিতে ব্যতিব্যস্ত। এসব শত্রæরা আমাদের চেতনায় খোড়ল তৈরি করে বানিয়েছে লোভের বাসা। তাই মানবিক আদ্য চেতনার সরল রেখা ঢেকে গেছে নিকষ অন্ধকারে। সমাজ মনস্কতার বোধে জাগ্রত কবি পিনু তাই খুঁজে ফেরেন বাতিঘর। বাতিঘরের অন্বেষণে তিনি তাড়িত হন, তাঁর পাঠককেও করেন। অন্ধকার মগ্নতার এই কালে কবি পিনু বাতিঘরের অন্বেষণে নিরন্তর পথ হাঁটেন কবিতায় :
বায়ু হতে বায়ুরোগ সৃষ্টি হতে থাকে
বাতাবী লেবুরা রোগাক্রান্ত, পড়ে যায়
এর মধ্যে বাসক গাছে বাঁধছে বাসা
পুরনো শত্রুরা।
এতটা উদাস হাওয়ায়
বাতিঘর দেখা যাবে কি এখন?১২
কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু রাজনীতি সচেতনতার মন্ত্র পাঠ করেন তাঁর কবিতায়। আজ এই দেশে এক নষ্ট প্রতিবেশে নিমজ্জিত রাজনীতি ও রাজনীতিকেরা। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের কথা না ভেবে, প্রগতির কথা না ভেবে আজেবাজে বিতর্ক আর ক্ষমতা দখলের, ক্ষমতা বজায় রাখার ক‚টকৌশলে ব্যস্ত তারা। আর এটাই অন্ধকার উপদ্রæত এই জনপদের মানুষের দুঃখের কারণ বলে চিহ্নিত করেন কবি পিনু। দিনে দিনে মানুষের হৃদয়ে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষত। যারা জাতিকে স্বপ্ন দেখাবে, সমাজকে এগিয়ে নেবে প্রগতির আলোর দিকে, তারা আজ আটকে আছে কোটারি স্বার্থের জালে। আর তাই ক্রমে বিপন্নতা জমাট বেঁধেছে মানুষের বুকের ভেতর। কষ্টজল বাড়তে বাড়তে ভরে গেছে নদী। অথচ রাজনীতিকেরা কুহেলিকা টেনে এনে ঢেকে দিয়েছে সুনীল আকাশ। হট্টগোলের ভেতর তারা পথ হাঁটে, তাদের মুখে তর্জন-গর্জন আর অপভাষা। তাদের কোনো ব্রত নেই, নেই হিতোপদেশ। এইভাবে এক নষ্ট আবহ তৈরি করে রাজনীতিকেরা ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের স্বপ্নের ঘরদোর। অসহিষ্ণুতার নোংরা জলে ভাসিয়ে নিয়ে প্রগতির নৌকা ভেঙে দেয় আলোকলতার বন। পিনুর কবিতায় উঠে আসে রাজনীতির আঁতুড় ঘরের এইসব ভয়াবহ চিত্র :
নষ্ট হয়ে যাচ্ছে–
বৈরী মাটিতে, বৈরী হাওয়ায়
স্বর্ণরেণুও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
এভাবে নষ্ট হতে থাকলে
অস্তিত্বের সমস্ত এলাকায় ঝাঁকে ঝাঁকে নামবে উঁইপোকা
তার আগে ক্ষোভ নিয়ে দাঁড়াতে চাই
এই মুখোমুখি।১৩
কবি পিনু নিরন্তর হেঁটে বেড়ান এই সমাজের অলিতে-গলিতে, মানুষের সুখ দুঃখের সাথী হয়ে। গভীর অভিনিবেশে পর্যবেক্ষণ করেন সমাজের চালচিত্র। অনুসন্ধিৎসার আলোয় তুলে আনেন লোভাতুর মানুষের লোভের আগুনে কী করে পুড়ে যাচ্ছে অতিসাধারণের বুকের ভেতর সঞ্চিত শস্যখনির স্বপ্ন? তা বলে তিনি দৈবের হাতে সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে রাজি নন। তিনি ভরা ভাদরে দুক‚ল প্লাবিত নদীর মতো মানুষের ফুঁসে উঠবার আহ্বান জানান, অপেক্ষায় থাকেন। তাঁর বিভিন্ন কবিতায় তিনি মানুষের অনির্বাণ শক্তির বন্দনা করেছেন। তিনি বুকের ভেতর সযত্নে লালন করেন দ্রোহের আগুন। যে আগুনে তিনি পোড়াতে চান লোভাতুর মানুষের জীবনের ধারাপাত। অল্পতে সন্তুষ্ট এ জনপদের মানুষের দুঃখের কারণ লুটেরা শ্রেণী। সাধারণ মানুষ ভাবে ভাগ্যের পরিহাস। কিন্তু কবি এই দীনতাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে আশার বাণী শোনান তাঁর কবিতায়। এ যেন জলের স্পর্শে গড়ে তোলা সাহসের বীজতলা :
দুঃখপীড়িতদের জন্য যারা উপমা খুঁজে নিয়ে কাতরায়
নদী সাঁতরিয়ে এপার থেকে ওপারে যায়– সজ্জন ও
ও আত্মীয় ভেে কাছে টেনে নিতে কুণ্ঠিত হয় না যারা, তারা
বারবার তাদেরই সৃষ্ট অমাবস্যায় তাদের নিয়ে ডুবে
যায়–তবে কি তারা ছদ্মবেশ নিয়েও অজস্র করুণার
নামে নিকৃষ্টতম নোংরামি-নষ্টামি করার জন্য এতদিন
ভেক ধরবার সাধনা করেছিল? তাদের অনিষ্ট থেকে বাঁচবার
জন্য নিপীড়িতরা কোনো অস্ত্র তৈরি করে নিজের
আয়ত্তে রাখ না?১৪
এ জাতি রাগতে ভুলে গেছে, দ্রোহের আগুন যেন বা নিভে গেছে বুকের ভেতর। বুককাঁপা কষ্ট নিয়ে জ্বর গায়ে জল ঢেলে কোনো রকমে বেঁচে আছে এ জাতি। শ্রমে-ঘামে নাস্তানাবুদ হয়ে প্রগতির চাকা টেনে চলেছে যারা, আজ তারা অসহায়, বঞ্চনার উঁইপোকা কুড়ে খায় তাদের জীবন। মাছ ভাতের স্বাচ্ছন্দ্য জীবনের স্বপ্ন হরণ করে তাদের চোখে ঝুলে থাকে অন্ধকার, বুকের ভেতর ঝুলে থাকে নিরাশার কালো মেঘ। কেবলই বঞ্চনার অধিক বঞ্চনায় তারা শীত গ্রীষ্মের ব্যবধান খুঁজতে থাকে, অথচ আগুন জ্বালাতে পারে না বুকের গহীনে। একদিন পাকিস্তান আমলে বাইশ পরিবারের সদস্যদের গালে চর্বি দেখে যে জাতি রেগে গিয়েছিল, দুর্নিবার সাহসে যে জাতি তাদের চর্বি পুড়িয়েছিল দ্রোহের আগুনে, সে জাতি আজ দেশীয় মুৎসুদ্দির বিরুদ্ধে কেবলই নির্বাক যেন বোধশক্তিহীন কোনো জড়পদার্থ বিশেষ। এসব দেখে গোলাম কিবরিয়া পিনু ভীষণ ব্যথিত, আর সে ব্যাথা ঝরে পড়েছে তার কবিতার অন্তর্নিহিত অনুভবে :
আমরা রাগতে পারছি না–
রোষবহ্নি ছড়ানো-তো দূরের কথা
দাঁত কিড়মিড় করতে পারছি না
রাগে গজ্গজ্ করতে পারছি না নিজের ভেতরও!
আমরা কি এখন বোধশক্তিহীন হয়ে যাচ্ছি?১৫
মুক্তিযোদ্ধা কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু বোধের গহীনে দেশপ্রেমের বাতি জ্বেলে পথ হাঁটেন। স্বাধীনতার চেতনায় ঋদ্ধ পিনু এই বদ্বীপে পরিশীলিত রাজনীতির স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখেন শোষণহীন বৈষম্যহীন এক সমাজ ব্যবস্থার; যা তাঁর কবিতার পরতে পরতে অনুরণিত। তিনি দেশপ্রেমের পাঠ তুলে দেন পাঠকের হাতে। রাজনীতির সংকীর্ণতা ও ক‚টভাষ্য তাঁকে ব্যথিত করে। তিনি কবিতায় স্বদেশপ্রেমের বাতি জ্বেলে জনতাকে সংঘবদ্ধ হতে উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি বিশ্বাস করেন, স্বদেশপ্রেমের অনিরুদ্ধ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে একদিন বাঙালি জাতি সত্যিকার অর্থেই স্বাধীনতার চেতনায় এদেশটাকে গড়ে তুলবেই। তখন রাজনীতিও হবে মানবিক সোহাগে পরিশীলিত জীবনের সূচিপত্র।
খ. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
—————————
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার অদম্য আকাক্সক্ষায় একাত্তরে যুদ্ধে নেমেছিল বীর বাঙালি। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার গর্ভে লুকায়িত ছিল বৈষম্যহীন এক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। কিন্তু স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই নির্মম ও নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালির সে স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে দেয়া হয়। তারপর বাঙালির অন্তরলোক থেকে একাত্তরের চেতনা নির্বাসনে পাঠানোর জন্য সবরকম প্রচেষ্টায় নেয়া হয়–স্বাধীনতা হয় অবরুদ্ধ! এরকম এক দুঃসময়ের ভেতর মুক্তিযোদ্ধা কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেন তাঁর কবিতায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ কবি কিবরিয়া পিনু জাগরণের গান শুনিয়েছেন তাঁর কবিতায়।
গোলাম কিবরিয়া পিনু শুদ্ধাচারী কবি। তিনি কবিতায় আত্মমগ্ন মানুষও বটে। কবিতার শুদ্ধচারী চেতনার অন্তর্লোকে নিয়ত বসবাস তাঁর। দেশ, সমাজ, মানুষ, প্রকৃতি, প্রেম ও মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ– এসব কিছুই তাঁর কবিতার অনুষঙ্গ। সমাজ মনস্কতার গভীর অন্বেষণ তাঁর কবিতার ছত্রে-ছত্রে। স্বাধীনতার চেতনায় অনিরুদ্ধ কবি পিনু ভীষণ প্রভাবিত মুক্তিযুদ্ধের দ্বারা। কবি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধেরও বীর মুক্তিযোদ্ধা একজন। আর সেজন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গভীরভাবে তুলে এনেছেন নান্দনিক শব্দ-শৈলীতে। সংগত কারণে বঙ্গবন্ধুও আছেন তাঁর কবিতায় স্বমহিমায়। বঙ্গবন্ধু ছাড়া বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন কিংবা স্বাধীনতা অর্জন কল্পনা করা যায় না। কবি যেন বঙ্গবন্ধুর চেতনার সাক্ষাৎ উত্তরাধিকার; ‘মুজিবের রক্তধারা’ কবিতায় কবি উচ্চারণ করেন :
[…] মায়ের নিজস্ব কোলে স্বপ্ন দেখে শিশু জেগে ওঠে
সেই শিশু কণ্ঠে উচ্চকিত হোক মুজিবের নাম
কেননা উত্তরাধিকারের অধিকারে থাকে মুজিবের রক্তধারা
আগামীর চোখ তাই মুজিবের চোখ।১৬
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভাবেই পিনুর কবিতায় ভাস্বর। ১৫ আগস্টের ক্ষতবিক্ষত নক্ষত্র দিন পিনুর চেতনায় জ্বেলে দেয় দ্রোহের আগুন। শাণিত হয় তাঁর কবিতায় চেতনার অন্তর্লোক। বোধের গহীন থেকে তিনি নিবেদন করেন বঙ্গবন্ধুর প্রতি হৃদয়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
রণাঙ্গনে যুদ্ধ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা যখন কবিতা লেখেন, তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেন কবিতার পরতে পরতে। নতুন প্রজন্মের পাঠক যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি, তারা মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করতে পারে পিনুর কবিতায় এবং মুক্তিযোদ্ধা কবির কবিতার অন্বয়ে ঋদ্ধ হয় পাঠকের অন্তর্লোক। পাঠক অধিভুক্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। কাব্যচেতনায় মুক্তিযুদ্ধ এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে। তাঁর কবিতার ভেতর যেমন বাঙালির জেগে উঠবার দিনগুলো দেদীপ্যমান, ঠিক তেমনি সামাজিক বৈষম্য আর তমসাবৃত বর্তমান ভেঙে আবারো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অধিভুক্ত হওয়ার আহ্বান। তাঁর কবিতা পাঠে মস্তিষ্কের নিউরনে বেজে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের দ্রিমি দ্রিমি তাল, আগুনের গোলক, বিদ্রোহী জনতা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লোলুপ আগুনে পুড়ে যাওয়া নিরীহ বাংলার সবুজ সংসার, রক্তধারায় প্রবাহিত নদী। পিনুর মুক্তিযুদ্ধের কবিতায় আছে কৃষিজীবীর ইশতেহার নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার, আছে সংহত জীবনযাপনের প্রত্যয়। আছে ধর্মান্ধ কালজ্ঞ শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নীলকণ্ঠ দৃপ্ত প্রতিবাদ, আছে মনস্তাপ থেকে জেগে উঠে ধ্যানমগ্ন হওয়া বঙ্গবন্ধুর চেতনার উত্তরাধিকারে। মুক্তিযুদ্ধের কবি বাঙালির স্বভাব-সৌন্দর্য ও প্রজ্জ্বলনের ক্ষমতাকে কবিতার অনিরুদ্ধ আলোয় উর্ধ্বে তুলে ধরেন, পাঠকের অন্তর্লোকে, চেতনার পিলসুজে আগুন জ্বেলে দিয়ে কাকাতুয়া-স্বরে ডেকে ওঠেন। কালের তমাসাবৃত দিনের ভেতর মনস্তাপ, শোকবিহŸলতা ভেঙে-চুরে প্রাণপ্রাচুর্যতা নিয়ে দুঃসাহসে জেগে ওঠার আহ্বান জানান, জ্বেলে দেন আকাশ দেউটি। যেমন :
চলো–অধিভুক্ত হই আবারও মুক্তিযুদ্ধে
চলো–কুণ্ঠামুক্ত হই আবারও মুক্তিযুদ্ধে
চলো– নবাঙ্কুর হই আবারও মুক্তিযুদ্ধে
চলো– প্রসববন্ধন হই আবারও মুক্তিযুদ্ধে।১৭
বাঙালির সর্বোত্তম অর্জন মহান স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এক নদী রক্ত ঢেলে বাঙালি স্বাধীনতা অর্জন করেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে উত্তাল সেই দিনগুলোতে এদেশের কিছু কুলাঙ্গার স্বাধীনতার বিরোধিতা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও আগুন জ্বালিয়ে সবুজ-শ্যামল বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল। সাম্রাজ্যবাদ আর মৌলবাদ এক কাতারে দাঁড়িয়ে বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধকে রুখে দিতে চেয়েছিল। হত্যাযজ্ঞ আর আগুনের লেলিহান শিখায় তারা বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাঙালির অজেয় শক্তির কাছে তারা পরাজিত হয়।
স্বাধীনতা উত্তর কালে বাঙালি ধবংসস্ত‚পের উপর দাঁড়িয়ে দেশ গড়ায় মনোনিবেশ করে। সবকিছু ভুলে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত আহ্বানে সারা দিয়ে মানুষ যখন দেশ গড়ার কর্মযজ্ঞে মেতে উঠেছে, ঠিক তখন একাত্তরের পরাজিত সাম্রাজ্যবাদী ও মৌলবাদী শক্তির গোপন ষড়যন্ত্রে নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। যেন বা তমসাবৃত দিনের অন্ধকারের ভেতর হারিয়ে গেল নক্ষত্রের আলো। পিশাচের উদ্বাহু নৃত্যের তালে তালে ঘাতকেরা বেরিয়ে এল কিরিচ হাতে। আর দেবশিশুরা বিহ্বলতার ভেতর অন্তর্মুখি। একাত্তরে অগ্নিগোলক ছুঁড়ে দেয়া যুবারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ততক্ষণে মায়ের জায়নামাজ ভেসে গেছে রক্তে। মানচিত্র খামচে ধরেছে শকুনের দল। তাদের চিৎকার-শীৎকারে অতিষ্ঠ বাংলার আনাচে-কানাচে ফিসফিসানি ভয়। নেতৃত্বহীনতার ভেতর কোঁকড়ানো অধিবাস, দুর্বিপাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভয়! হারিয়ে যায়, মানুষের চেতনার ব্যাপ্তী অবরুদ্ধ সময়ের ভেতর, অক্সিজেনবিহীন জলাশয়ে মাছের মতো কেবলই খাবি খাওয়া যেন। রক্তমাখা পোশাক, পোড়াবাড়ি, ছিন্নভিন্ন গাছের ডগা ও লতা আর যুদ্ধদিনের সমরসজ্জা ভুলে গিয়ে বাঙালি তখন কেবলই অন্তর্মুখি। বোধের শান-শওকত হারিয়ে ফেলে ভয় ভয় সময়ের ভেতর রোদ্রহীন আলোহীন অন্ধক‚পের বাসিন্দা। তমসার বাঁকে বাঁকে হিংস্র জানোয়ার, হিংস্রাশ্রয়ী বর্বরতার হাতে শানানো তলোয়ার, কিস্তি-টুপি মাথায়, বিড়াল তপস্বী, কেতাদুরস্ত বকধার্মিক তারা। নক্ষত্রহীন দিনের ভেতর থমকে যায় সময় বধিরতায় হারিয়ে যাওয়া ঐকতান। ঠিক সেসময় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কবিতার ডালা সাজিয়ে আনেন মানুষের কাছে। পৌষের কুয়াশাচ্ছন্ন দিনের ভেতর যেন রৌদ্রের উত্তাপ। পিনু জেগে উঠার কথা বলেন, প্রতিরোধের কথা বলেন, বলেন প্রতিশোধের কথাও। একাত্তরের অজেয় সাহসে রক্তমাখা পোশাকে আবার দাঁড়িয়ে যাবার কথা বলেন :
ভুলে গেছি কি সমরসজ্জা?
উঠানে এসে কারা করেছে ফুলবাগান কব্জা!
অসূয়া নিয়ে পা ফেলবে এখানে ওখানে শুধুই পিশাচ?
সাহসগুলো হারিয়ে ফেলে নাচছি কী নাচ?
রক্তমাখা পোশাকে আবার দাঁড়িয়ে যা বাপ
কাটারি হাতে কাদের পায়ের ছাপ?১৮
জাতির পিতাকে হত্যার পর কারা ঢেকে রাখে আমাদের শুদ্ধ সকাল? কারা মুক্তিযুদ্ধকে নিশি যাপনে ঠেলে দিয়ে পাহারা বসায় প্রতি ঘরে? জাতি বন্দী হয়ে যায় নিকশ অন্ধকারে। যুদ্ধের অমিত তেজ নিভে যায় বিভ্রান্তির চোরাবালিতে। সূর্যদিনের আলো পৌঁছাতে পারে না বন্দীপ্রকোষ্ঠে কিংবা চেতনালোকে। দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে রেখে মানুষের অধিবাস আরোপিত অন্ধকারের ভেতর চিরস্থায়ী হয়। নিজস্ব আকাশে তাকানোর অধিকারহীন মানুষ বসন্ত বাতাসেও বুকের ভেতর কষ্ট নিয়ে অনটনে কাটায় দিন। অথচ স্বাধীনতার শত্রæরা দাঁতাল শুয়োরের মতো দাপিয়ে বেড়ায় চরাচর। যেন সূর্যদিনের আলো তাদের জন্যই চিরস্থায়ী। তারা থাকে দুধেভাতে, মাখন ও ঘিয়ে। আর মুক্তিযোদ্ধা ও সুশীল মানুষ বিভ্রান্তির চোরাবালিতে আটকে গিয়ে হারিয়ে ফেলে বুকের সাহস, অমিত তেজ। কবিতায় কবি পিনুর সেই আক্ষেপ অনুরণিত হয় : ‘আয়ুষ্কাল ঝাঁ-ঝাঁ পাবেনা কোন নাগাল?/ আমাদের দিন নেই! শুধু রাত্রিবেলা–শুধুই সূর্যাস্তকাল!’১৯
আজ চোরাস্রোতে ভেসে যাচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বোধ। বোমা-বারুদের গন্ধের ভেতর আমরা ক্রমাগত অন্য দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে উঠছি। চারদিকে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস, আমাদের শিশুরা মরছে অবলীলায়, মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের হাতে নাঙা তলোয়ার– চেতনার সবুজ বসতি ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। আলখাল্লা পরে শয়তানগুলো জাতির পায়ে শেকল বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মধ্যযুগের দিকে। অথচ আমরা প্রতিবাদহীন। আমাদের অমিত তেজের সন্তানেরা আজ অসুরদের ভুল শিক্ষা নিয়ে ভুল ঠিকানায় হেঁটে যায়। কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত গোটা জাতি যেন হারিয়ে ফেলেছে প্রতিবাদের ভাষা। নারদেরা মুঠো-মুঠো অন্ধকার ছুঁড়ে দিয়ে জাতিকে আলোকশূন্যতার ভেতর বন্দী করতে মহাতৎপর। অথচ বীর বাঙালি জ্বলে উঠতে পারছে না। এই মনোবেদনার ভেতর গোলাম কিবরিয়া পিনু লিখেছেন :
বারবার নিয়ে যেতে চায় মধ্যযুগে
আলখাল্লা পরে!
নিবিড় অন্ধকারের ভেতর কি দীপশিখা জ্বলে?
কথা নাকি খাটিয়ায় লাশ নড়েচড়ে?
সাহসের নামে আলোকশূন্যতা বুকে!২০
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মহোত্তম কালে যে শিশুর জন্ম কিংবা যে শিশু অবাক বিস্ময়ে দেখেছে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিস্ফ‚রণ, অগ্নূৎসব ও বিজয় গাথা, ধীরে ধীরে সে শিশু তার হৃদয় মন্দিরে স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বজন হারানোর সন্তাপ নিয়ে বড় হওয়া সেই শিশু ঋদ্ধ হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। শত বিভ্রান্তির মাঝেও তার মনোলোকে জাজ্বল্যমান রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদারদের ধ্বংসলীলা। তৈরি হয় তাদের প্রতি অফুরান ঘৃণা। এইভাবে যুদ্ধশিশু তার অসম্পূর্ণতা দূর করে ক্রমে প্রসারিত হয়; নিজের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের অনিরুদ্ধ চেতনায় লাভ করে অমিত তেজ। অরণ্যপুষ্পের গানে বোধের গহীনে তার কম্পন জাগে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো ধারণ করে বুকে এ শিশু হয়ে ওঠে আগামী দিনের মারণাস্ত্র; যার প্রমাণ শাহবাগের জাগরণ। তারা নক্ষত্র দিনের মতো উত্তাপ ছড়িয়ে প্রাণময়তা জাগিয়ে রাখে মানুষের। তাদের হৃদয় মন্দিরে একাত্তরের স্বর্ণোজ্জ্বল অধিবাস, যার নাম বাংলাদেশ। কবির ভাষায় :
যুদ্ধ শিশু অনুকম্পা নিয়ে বড় হতে হতে
যে কম্পন অনুভব করে
তার নাম বাংলাদেশ!
তারপরও অন্তর্জগতের ভেতর আত্মবুদ্ধি নিয়ে
নিজমূর্তিতে প্রাণময়তা জেগে রাখে।২১
মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্যাবহৃত অমূল্য সব জিনিসপত্রে আমাদের যাদুঘর সমৃদ্ধ হতে পারতো। সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত সেসব সম্পদ সংশ্লিষ্ট এলাকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিংবা ইতিহাসের সাক্ষী। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সে ইতিহাস উপস্থাপনের জন্য সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি এবং সর্বসাধারণ্যে তা প্রচার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্র্ণ। আর সে কাজটির জন্য একমাত্র প্রতিষ্ঠান যাদুঘর। অথচ জাতীয় যাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা অবহেলিত যা একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদের জন্য অত্যন্ত কলঙ্কের। এই কলঙ্কদশা কবি পিনুর মনোবেদনার কারণ।
মুক্তিযোদ্ধা কবি যাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের এমন দৈন্যদশা দেখে মর্মাহত, বেদনাগ্রস্ত। মুক্তিযুদ্ধ যেন অচল মুদ্রার অপর নাম! মুক্তিযুদ্ধের রৌদ্রগন্ধ প্রবেশ করতে পারে না জাতীয় যাদুঘরের পাষাণ প্রাচীর ভেদ করে। কবির আক্ষেপ মনোবেদনা পরিস্ফুটিত তাঁর কবিতায় :
যাদুঘরে গিয়ে দেখি প্রিয় মুক্তিযুদ্ধ
একটি ছিন্ন বিবর্ণ দৈনিকে!
একটি ছেঁড়া রক্তাক্ত পোশাকে!
একটি ছোট অস্পষ্ট ছবিতে!২২
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই নিহত হলেন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর বিরতিহীন অন্ধকারের ভেতর পথ চলা। এতিম স্বাধীনতার চামড়া ফেটে খসখসে হয়ে গেল। পরাজিত শক্তির উত্থানে থেমে গেল দখিনা বাতাস। যা ইচ্ছে তাইÑ কেবলই শেখানো হয় উল্টো কথা উল্টো বুলি। যেন মুক্তিযুদ্ধ চুরি করা কোনো এক এতিম শিশু। তাকে যেমন খুশি চড়-থাপ্পর মারা যায়। কোনো প্রতিবাদ হওয়ার নয়। ঐকতান থাকে না সঙ্গীতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধ্বণি প্রতিধ্বণিত হয়না ইথারে। দুঃসহ বেদনার ভেতর মুক্তিযুদ্ধ খেলায় পরিণত হয়। রুটি-মাংস-পনিরের লোভে খেলোয়াড় খেলে যেতে থাকে, রঙ বদলে খেলে যেতে থাকে। ক্রমাগত লোভের আগুনে পুড়তে থাকে জনপদ, রক্তাক্ত হতে থাকে সুশীল বিবেক। আর সে যন্ত্রণা সংক্রমিত অনুভবে পিনুর কবিতায় উঠে আসে মর্মবেদনা :
আমাদের গৌরবের পরিচয়বাহী মুক্তিযুদ্ধ
খাপছাড়া অবস্থায়
বার বার বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে।২৩
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রæরা ইতিহাসের আস্তাকুঁড় থেকে উঠে এসে দাপিয়ে বেড়ায় জনপদে। তাদের দাঁতে-নখে স্বাধীনতার জনকের রক্ত, হাতে নাঙা তলোয়ার। তারা মুক্তিযুদ্ধকে গভীর অরণ্যে নির্বাসিত করতে চায়, ইট-পাথর চাপা দিয়ে তারা ভাবে মুক্তিযুদ্ধ শেষ; স্বাধীনতা মরে গেছে। তারা তখন বলদর্পী জল্লাদ যেন, হাঁটে ঘোরের ভেতর– মাতাল স্বভাবে। তারা ভাবে ইতিহাস নিজেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত। তাদের চেতনার ভেতর কিলবিল পোকা উগড়ায় বিষ। আর তাদের বিষ-সন্ত্রাসে সদা সন্ত্রস্ত থাকে নিরীহ বাংলা জনপদ। তারা ভুলে যায় আনাগত ভবিষ্যতের কথা, আগামীর ইতিহাস হয়তো তাদের কোনো আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে। কিন্তু কবি তাঁর কবিতায় সেসব দিনের ইঙ্গিত তুলে ধরেন নষ্ট চিন্তায় মগ্ন জল্লাদের দিকে :
[…] ইটের ভেতর অদৃশ্য অল্পবিস্তর জায়গায়
মুক্তিযুদ্ধ ঘাসফুল হয়ে ফুটে থাকে!
এরপর রয়েছে ইতিহাসের আগামী।২৪
বাঙালি বীরের জাতি; একথার প্রমাণ রেখে গেছেন আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা। ঈসা খাঁর মতো বার ভূঁইয়া বা সুভাষচন্দ্র, সূর্য সেন, বঙ্গবন্ধু; তাঁরা বাঙালির বীরত্বের উত্তরাধিকার তুলে দিয়ে গেছেন আমাদের হাতে। আমাদের দিয়ে গেছেন সোনার সকাল। আয়ু-পরমায়ু দান করে গেছেন তাঁদের জীবনের বিনিময়ে। তাঁরা আমাদের শিখিয়ে গেছেন শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে। তাঁরা নিয়ত যুদ্ধ করে গেছেন অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। আমরা যারা তাঁদের উত্তরাধিকার, আমাদের সুখের জন্য তাঁরা সর্বদা অস্থির থেকেছেন, যেন আমরা নক্ষত্রদিনের আলোয় পথ চলতে পারি অনন্ত আগামীর। তাদের ত্যাগের মহিমায় আজ আমরা স্বাধীন জাতি। কবি পিনু আমাদের পূর্ব-পুরুষের প্রতি শ্রদ্ধাবনত কাব্যভাষায় তাই স্মরণ করেছেন তাঁদের :
পূর্বপুরুষেরা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য
মধ্যরাত থেকে ভোরবেলা জেগেছিলেন।
প্রাতভ্রমণের সময়ে দুর্দিনের কুকালে
সময়ের তলায় রেখে–
শুভসকাল এ হাতে তুলে দিয়েছিলেন।২৫
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থেকেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালির উজ্জীবনের প্রতীক। তখন শিশুর মুখেও উচ্চারিত হতো শেখ মুজিব। বাঙালির রক্তের ভেতর মিশে গিয়েছিল মুজিবের নাম। স্বাধীনতার সেই শিশু বড় হয়ে দেখে মানুষের মুখ থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে মুজিবের নাম; এমন কি কেড়ে নেয়া হচ্ছে তারুণ্যের স্বপ্নও। বুকের ভেতর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আবাস তৈরির উষ্ণতা। যারা পদ্মফুলের মতো স্বাধীনতার পবিত্রতা নষ্ট করে দিয়ে চায়, তারা মেতেছে ষড়যন্ত্রে। মুজিবের নাম তাদের কাছে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র। তারা জানে মুজিবের চেতনায় ঋদ্ধ এই মানুষ এক সময় তেতে উঠবে দ্রোহের আগুনে। অতএব, মুজিবকে উৎখাত করো; কিন্তু তারা জানে না মুজিবের রক্তধারা মিশে আছে বাঙালির মস্তিষ্কের কোষে কোষে। দুর্দিনে দুঃসময়ে আবার এ মানুষ ফুঁসে উঠবে, সাথে থাকবে মুজিব আর তাঁর সোনার বাংলা গড়ার আদর্শিক চেতনা :
[…] মায়ের নিজস্ব কোলে স্বপ্ন দেখে শিশু জেগে ওঠে
সেই শিশু-কণ্ঠে উচ্চকিত হোক মুজিবের নাম
কেননা উত্তরাধিকারের অধিকারে থাকে মুজিবের রক্তধারা
আগামীর চোখ তাই মুজিবের চোখ।২৬
বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ স্বদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বাঙালি স্বাধীনতারক জন্য যুদ্ধে গিয়েছিল। অথচ শুদ্ধ জলের তৃষ্ণা নিবারণ হওয়ার আগেই অন্ধকার নেমে এল। তারপর বাধাহীন শোষণের পঙ্কিল আবর্তে ঘুরপাক খাওয়া শোষণের এই আবর্তন থামাতে যুদ্ধের কেনো বিকল্প নেই। এবং এ যুদ্ধ হবে মুক্তিকামী মানুষের যুদ্ধ, এ যুদ্ধ হবে মুক্তচিন্তার মানুষের যুদ্ধ, এ যুদ্ধ হবে– শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের জন্য কবি সকল নির্যাতিত মানুষকে যূথবদ্ধ, দলবদ্ধ হতে আহ্বান জানান, দ্বিধাহীন হয়ে এই যুদ্ধে আসার আহ্বানও জানান। কবি এই যুদ্ধের পরে সমাজের কারুকার্যময় বিকাশের স্বপ্ন দেখান। যেমন :
[…] শিথিল শিরায় উষ্ণ রক্ত প্রবহমান হোক
আমরা দাঁড়ালে যুদ্ধ হবে
শত্রুরা পালাবে উর্দ্ধশ্বাসে
অতঃপর আমাদের কারুকার্যময় সজ্জিত বিকাশ।২৭
দুর্বার গণঐক্য নিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তারপর ক্রমাগত অন্ধকারের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে বিভাজনের রেখা দীর্ঘ হয়েছে। কুঁদুলেপনায় মেতে থাকে গোটা জাতি দীর্ঘ সময়। আর এই বিভাজনের ভেতর জাতিকে আটকে দিয়ে সুবিধাভোগীরা তাদের স্বার্থ আদায়ে তৎপর থাকে। বিভাজনের এই ইতিহাস অতি দীর্ঘ; পিনু কাব্যভাষায় তার স্বরূপ :
পায়ে পায়ে কোন তাল নেই
বিভাজনের কোটরে গিয়ে পৌঁছি আমরা
পুষ্পরেণু নিয়ে চৈত্রমাসে
কৈলাস পর্বত থেকে হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছি
সমকোণ থেকে ফিরে যাচ্ছি স্থ‚লকোণে২৮
হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি তাঁর ঐতিহ্য নিয়ে পরিপূর্ণ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয় মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই স্বাধীনতার পরাজিত শত্রæরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবরে হত্যা করে স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার চেতনাকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। এমনকি স্বাধীনতার চেতনাকেও নির্বাসনে পাঠাতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। আর সেই দুঃসময়ে কবি-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা স্বাধীনতার চেতনাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে জীবনপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। কবি পিনু সেই সংগ্রামের একজন সাহসী সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করেন এবং তা ছড়িয়ে দেন তাঁর কবিতায়। কবি বিশ্বাস করেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অবশ্যই উজ্জীবন ঘটবে বাঙালি জাতির।
গ. জীবনবোধ
———————–
কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু কবিতায় আত্মমগ্ন থেকে নিরন্তর পথ হাঁটেন। সাংবাদিকতার অনুসন্ধিৎসায় তিনি অনিমেষ পর্যবেক্ষণ করেন যুগ-যন্ত্রণায় পিষ্ট ব্যক্তি ও সমাজ-জীবন, বণিক লালসার অনাত্মীয় মানুষের শোষণের কলা কৌশল। দেখেছেন বিড়াল তপস্বী মানুষের হাঙর রূপ। এতসব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে বোধের গভীরে জোসনার রোদ আর জলের স্পর্শে গড়ে তুলেছেন কবিতার প্রাতিস্বিক ভুবন। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে জলের বিচিত্রমুখী অনুরণন। জলের অন্বয়ে কবি যেমন এঁকেছেন সাহসের বীজতলা, ঠিক তেমনি বানভাসি জলে মানুষের কষ্টের সূচিপত্র। তিনি তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন মানুষের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনে কেমন করে শোষণের অদৃশ্য হাত আরো কষ্ট বাড়ায়। তিনি মানুষের কাছে ভরা ভাদরের নদীর মতো ফুঁসে ওঠার প্রত্যাশা করেছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে। পিনুর কবিতায় আছে জলের স্পর্শে জীবন সোহাগে এক নতুন মানবিক সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা। নান্দনিক চিত্রকল্প ও শব্দশৈলীতে গড়ে তোলা পিনুর কবিতা পাঠক-হৃদয়ে ঢেউ তোলে। গোলাম কিবরিয়া পিনুর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ মানুষ ও মানবসৃষ্ট নানান অসঙ্গতি। মানুষের প্রতি প্রকৃতির মমত্ব-সোহাগ এবং অনাত্মীয় মানুষ কতৃক প্রকৃতি ধ্বংসের মহাযজ্ঞও উঠে এসেছে তাঁর কবিতায় অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে। পিনুর কবিতা বিচিত্রমুখি বিষয় নিয়ে পাঠককে দেয় ভিন্ন স্বাদ, ভিন্ন উপলব্ধির সজীবতা। আর তাই এক নতুন মানবিক সমাজ গড়ার প্রত্যয় শেকড় গাড়ে পাঠকের মনোলোকে। এভাবে পাঠককে আলোড়িত করতে পারা পিনুর কবিতার অন্যতম সফলতা। পিনুর কবিতা সামগ্রিকভাবে জলস্রোতের মতোই ধাবমান হয়ে জীবনবোধের সোহাগ ছড়িয়েছে।
মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন এক নৈমিত্তিক ঘটনা। তাছাড়াও আছে নানা মাত্রিক জটিলতা। বর্তমানে মধ্যবিত্ত সমাজ-জীবন ক্রমান্বয়ে জটিল থেকে জটিলতর পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। বিপন্ন বোধের ভেতর হেঁটে যায় কালো মেঘ। বুকের ভেতর সুখের বসত-বাড়ি ক্রমান্বয়ে মলিন হতে থাকে। দুঃসময়ের গর্ভে জন্ম নেয় অস্তিত্বহীনতার ভ্রƒণ। একদা বুকের ভেতর স্বপ্ন ছিল, ছিল স্বপ্ন পুরণের দুর্বিনীত সাধ– তা আজ আর নেই। জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত হলে যা হয়! শ্যাম রাখি না কুল রাখি? একদিকে মধ্যবিত্ত আবেগ, অন্যদিকে রঙিন জীবনের লোভ, একদিকে নৈতিকতা আর দিকে সুখ নামের সোনার হরিণ! চেতনার ভেতর উৎকণ্ঠা বাড়তে থাকে। বিপন্ন বোধের ভেতর অস্তিত্বহীনতার শঙ্কা জন্ম নেয়। অন্ধকার ঘনীভ‚ত হতে থাকে বুকের ভেতর। দ্বৈত সত্তার ভেতর নৈতিকতার শেকড় ধরে টানে বাদুরেরা, যাদের সুপ্ত অবস্থান থাকে চেতনার এক কোণে। মধ্যবিত্তের বিপন্নতার এই কালে, তোতলানো ও বধির সময়ে নষ্ট প্রবৃত্তিগুলো উন্মাদপ্রবণ হয়ে ওঠে। এবং গোলাম কিবরিয়া পিনু মধ্যবিত্তের অন্তর্গত জটিলতা শিল্প-সৌকর্যে নিপুণ দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন তাঁর কবিতায়। বোদ্ধা পাঠকের চেতনায় তাঁর কবিতা ফুল ফোটাবে নিশ্চয়! কবি মধ্যবিত্তকে তাই শাণিত হওয়ার মন্ত্র দেন :
চিড়েমুড়ি-মাছঝোল-শাক-ভাত-দুধ
নিশিভোরে ঘরে ঘরে যেন ভিত পায়,
ধুলোমাখা পথে আমাদের কালসূত্র লেখা থাকে
বায়ু হিল্লোল কি সেই কল্লোল শোনায় না?২৯
এখন এক গদবাঁধা সময়ের ভেতর নিরন্তর বসবাস কবির। কারণ, সংসার জীবনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে রুটিনবদ্ধ সময়ের মধ্যে হারিয়ে যায় রঙধনু স্বপ্নগুলো। তবু ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি আর স্বপ্ন আলোড়ন তোলে চেতনার গভীর জলে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার চত্বরে পড়ে আছে কবির এক স্বর্ণধ্যায় জীবন। কবি আজ মধ্যবয়সী এক সংসারী মানুষ। শিক্ষাজীবন শেষে এতটা বছর পরেও তিনি ভুলতে পারেন না তাঁর প্রিয় মতিহারের সেই আড্ডার দিনগুলো, প্রিয় মুখগুলো। মতিহার এখনো কবির বুকের ভেতর দ্যুতিময়, বারবার কাঁপন তোলে একান্ত আপন সময়ে, কবি আক্রান্ত হন নস্টালজিয়ায়। ব্যথা জেগে ওঠে, জেগে ওঠে পুরনো দিনের গান। শৃঙ্খলিত পাখির মতো কবি ছটফট করেন বাঁধন ছেঁড়ার। মতিহারের সবুজ চত্বরে কবি যে শিক্ষা আর জ্ঞানের আলো অর্জন করেছেন আজ তাই নিয়ে কবি বেঁচে আছেন। মতিহারের প্রেমে ঋদ্ধ কবি তাই উচ্চারণ করেন :
বংশচ্যুত হতে পারি– মতিহারচ্যুত হতে পারি না কখনো।
মতিহার আজও হিরণ্যগর্ভ থেকে পাখা মেলে
এত উজ্জলতা এত বিভা এত রূপ
ক‚প থেকে মনে হয় আবারও যাই।৩০
জল ও জলকন্যা বাংলা কবিতার এক অনুপম অনুষঙ্গ। তারই ধারাবাহিকতায় কখনো কখেনো পিনুর কবিতায় জলবন্দনা ভাস্বর হয়ে ওঠে যা প্রণিধানযোগ্য। জলহীন জীবন সে তো মৃত্যুর অধিক অন্ধকারের ভেতর কষ্টের সূচিপত্র। পিনুর কবিতায় কাকচক্ষু নির্মল জলের বন্দনা যেমন আছে, ঘোলা জলে হারিয়ে যাওয়ার অনিঃশেষ কষ্টও আছে। বোধের অন্তর্গত গহীনে জল সিঞ্চনে যেমন গড়ে ওঠে আগামী দিনের প্রত্যাশিত কবিতার সুপ্রভা শরীর, তেমনি জলাবনত মেঘের দিকে দুহাত বাড়িয়ে থাকে খাঁ-খাঁ বীজতলা অঙ্কুরোদ্গমের প্রত্যাশায়। জল ডোবায় ভাসায় কাঁদায় আবার জলকেলিতে মেতে ওঠে ষোড়শী ও সারসিরা। জলকন্যার মিথ বাংলা সাহিত্যের এক অপরূপ রূপকথা।
জলের গভীরে হাবুডুবু সংসার, ক‚লভাঙা জলের স্রোতে সর্বনাশের ষোলকলা। জল স্পর্শে জল সমতায় শস্য সুফলা বাংলাদেশ। জল বর্ষায় ফিরে আসে ছেলেবেলা সকল মানুষের, কবিও মেতে ওঠেন কাব্যকলায়। জলের জাগরণে মালিন্য ধুয়ে শুরু হয় নতুন মাত্রা, শ্রাবণ ধারায় ওঠে শিহরণ বাঙালির জীবনে। জলের অহঙ্কারে ভরে ওঠে কৃষাণের গোলা, তৈরি হয় নিরাপত্তার আধার। জলের ছোঁয়ায় যেমন জেগে ওঠে নতুন প্রাণ, ঠিক তেমনি জলকষ্টের ভেতর বোঝা যায় জলের মাহাত্ম্য। জলের সুষমায় ভেঙে পড়ে চৈত্রের দাবদাহ। জলের সাথে সবুজ সখ্যতায় মৃত্তিকার অভ্যন্তরে দুর্বিনীত সাহসের অঙ্কুরোদ্গম হয়। এভাবেই কবি পিনু গড়ে তোলেন জল টলমল কবিতার যুবতী-শরীর।
বাঙালির মানস খুঁড়ে তার সফলতা-ব্যর্থতা তুলে আনতে দারুণ পারঙ্গম গোলাম কিবরিয়া পিনু। আর এ কাজে তিনি দেখিয়েছেন জলের ভূমিকা অবশ্যম্ভাবী প্রেরণার উৎস। জল বদলে দেয় বাঙালির মনোলোক। জলের সুষমায় বাঙালির মনোলোকে গড়ে ওঠে মানবতার তৃণভ‚মি অথবা সবুজ সখ্যতার অনন্য জগত। জলের সুধা নিয়ে কর্মযজ্ঞে মেতে ওঠে কৃষাণ-কৃষাণী। তখন আবেগের জল এসে কিভাবে মানুষের হৃদয়াবেগ বাড়ায় তা অনুপঙ্খ তুলে এনেছেন পিনু তাঁর কবিতায়। শুধু মরা গাঙে নয়, মানুষের বুকের ভেতরও আবেগের ফল্গুধারা বয়ে যায় জলের অপার মহিমায়।
জলের ভেতরই মানুষের জন্ম। গর্ভাশয়ের জল ভেঙে নবজাতক জন্ম নেয়, প্রস্ফুটিত হয় পৃথিবীর আলোয়। উদ্ভাসিত সময়ের ভেতর জলের অন্বয়ে বেড়ে ওঠে নবজাতক অনিরুদ্ধ আলোর চেতনায়। জলের প্রবাহে ক্রমাগত বাড়তে থাকে জীবন প্রবাহ। জলের মহিমায় যেন মানুষ গড়ে তোলে জীবনের গভীরতা। আবার জলের বিপরীত খেলায় নেমে আসে সর্বনাশের জমদূত। ক‚ল ভাঙে ঘর ভাঙে, ভেঙে ভেঙে ভাঙনের খেলায় মেতে ওঠে সর্বগ্রাসী জলের অনিরুদ্ধ শক্তি। অন্যদিকে জলও গতি হারিয়ে থমকে যায়, ভীষণ কষ্টে, অনাত্মীয় মানুষের নিষ্ঠুর আচরণে। জলের মমত্ব না বুঝেই অনাত্মীয় মানুষেরা ধ্বংস করে জলাধার। এ যেন কবি পিনুর জীবন ঘনিষ্ঠতার নিবিড় উপলব্ধি :
জলের গতিপথ রুদ্ধ করতে করতে
নিজেরাও থেমে যাচ্ছি
স্তব্ধ গতি অচঞ্চল হয়ে
থিতু হয়ে পড়ি।৩১
মহামতি লেনিন মানবজীবনের বাস্তবানুগ এক ব্যাখ্যায় জানিয়েছেন : ‘পুঁজিবাদ মানুষকে যন্ত্রে রূপান্তরিত করে।’ আর সেই পুজিবাদের উৎকর্ষতার এই যুগে সাম্রাজ্যবাদের মুক্তবাজার অর্থনীতির দুষিত হাওয়ায় জংধরা যন্ত্রে পরিণত হয়েছি যেন আমরা। অনিবার্যভাবে আজ মানুষের বুকের ভেতর মজানদীর হাহাকার। অনেক বছর আগে একদিন বঙ্গবন্ধুর হৃদয় উৎসারিত জলে সিক্ত হয়েছিল এ জনপদের মানুষ। তারপর সাম্রাজ্যবাদের ক‚টকৌশলে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর এখানে কেবলই খরা-মগ্নতার দিন, কেবলই ধূসর বালুকাবেলা। আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষণ বিমুখ, বৃষ্টিমগ্নতা শূন্য হৃদয়-ভ‚মি। নদীগুলো আজ হাজা-মজা। মেঘ চুম্বিত জলের ধারায় ভাসে না জীবন। কেবলই হাহাকার নদী আর ফসলের মাঠে শোষণের শেকলে বন্দী মানুষ, তার বুকের ভেতর কেবলই গভীর হাহাকার। জলের প্রার্থনায় চাতক পাখির প্রতীক্ষা কেবল। বৃষ্টি মুখরিত দিনে জলমগ্নতার ভেতর ধুয়ে যাক শোষণ-বঞ্চনা, পাপ পঙ্কিলতা আর রুদ্র খরার দিন। এরকম এক আকাক্সক্ষার স্বপ্ন বোনে পিনুর কবিতার শরীর :
[…] বরিষণমুখরিত পবনহিল্লোল আজ
সাজ পরে আসুক-ভাসুক ধুলোপড়া পথঘাট
ভিজে যাক আমারও বালুভরা মাঠ!৩২
জলের দীপ্র শক্তিতে জেগে ওঠে ধরিত্রী– খরামগ্ন বিষণ্ণতা কেটে গিয়ে জেগে ওঠে জলের অন্বয়ে শ্রাবণের রাতে। শ্রাবণের রাত মুষলধারায় জল সিঞ্চন করে খরামগ্ন জীবনের গভীরে। জলের দীপ্র শক্তিতে কিরণমণ্ডিত জীবন খুঁজে পায় সজীবতা। জলের গর্ভ থেকে উঠে আসা বৃষ্টির ভেতর বাদল বাতাস নতুন সৃষ্টির উন্মাদনা দিয়ে যায়। অথচ প্রগতির শত্রু যারা তারা বোঝে না, জলমগ্মতা ও জলের অন্বয় ব্যতীত জন্ম হয় না নতুনের। এক ধরনের দাঁতলাগা সংজ্ঞাহীন অবস্থার ভেতর তারা পড়ে থাকে। জলসজীবতার ভেতরও তারা আদ্যজ্ঞান ফিরে পায় না। বিভ্রমের চোরাস্রোতের ভেতর মজে থাকে প্রগতির শত্রæরা। কবি অন্ধকার মুষলধারার ভেতর তাঁর চেতনার প্রস্ফুটন অনুভব করেন। দেখেন, জীবনের বিস্তার। তিনি ভুলতে পারেন না আঁতুরঘর; সৃষ্টির প্রথম সূর্যোদয়। তিনি পাঠককে সৃষ্টির মূলে যাবার জন্য অনুপ্রাণিত করেন– বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করে। তিনি পাঠককে নিয়ে যেতে চান প্রগতির পথে। তাঁর সংস্কৃতি চেতনার স্রোতধারায় উদ্ভাসিত হয় পাঠক-হৃদয় :
প্রস্ফুটন হলো এ মুষলধারায়
এরপর কী বিস্তার!
জীবন স্রোতের বিপরীতে আঁতুরঘর ভুলিনি,
বন্যাকবলিত হওয়ার পরও–
উৎপত্তিমূলে ফিরে আসি সিক্তনদী খুলে খুলে।৩৩
প্রতীকী ব্যঞ্জনায় কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু মানুষের স্বপ্ন পূরণের ছবি আঁকেন তাঁর কবিতায়। যান্ত্রিক জীবনের যন্ত্রণায় মানুষ দিশাহারা, সুখ-দুঃখের দোলাচলে যখন কষ্টের ভেতর ঢুকে পরে জীবন, তখন স্বপ্ন পূরণের অনিরুদ্ধ আলোয় পিনুর কবিতা হয়ে ওঠে জীবনপুরাণ। মানুষের কষ্টের মরুমগ্নতার ভেতর ধোঁয়াটে আকাশ কেটে যায়, বর্ষাভেজা দিনে বাদল বাতাসে। তৈরি হয় মরুদ্যান। পাঠকের বিবেকে নাড়া দিয়ে পিনুর কবিতা এগিয়ে যায় নৈতিকতার সরল রেখায়। সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা থেকেই কবি সমাজ বদলের তাগিদ অনুভব করেন বোধের একান্ত গহীনে। আর তাই মুঠো-মুঠো স্বপ্ন বুনে দেন কবিতায়। দারিদ্র্যতা ও বৈষম্যের ভেতর ক্লিষ্ট হতে-হতে নিরন্ন মানুষেরা হারিয়ে ফেলে মানবতার আদ্য অনুভব, অনিন্দ্য স্বপ্নের ঘরদোর। কবিতার কারিগর পিনু সেই ঘরদোর মেরামত করেন নান্দনিক উপস্থাপনায়। তখন পাঠকও ভাসতে থাকে বাদল বাতাসে :
বায়ু দূষণের মহামারী এ নগরে
খলনায়কের ক্ষেত্রসুধা এ নগরে
বৃষ্টি নেই, জলকষ্ট-খরা
–ধুলোমাখা জ্বরা,
বনফুল টেনে নিয়ে হই মাতোয়ারা।
গৃহনামে খুপরি ছেয়ে যাই
কম্পনে কম্পনে হই অরণ্যজাত
কিসের জাতপাত!
শ্রাবণের আগলভাঙা মুষলধারা চাই।৩৪
বাঙালি মূলত ভূমিপুত্র। সে যেখানেই যাক, যত দূরেই যাক মাটির টানে সে এক সময় স্বগৃহে ফিরে আসে। বানভাসি হয়ে গৃহহারা মানুষেরা ভেসে যায় দিগি¦দিক, নানা প্রতিক‚লতা ভেঙে কেউ প্রতিষ্ঠা পায়, কেউ ভাসতেই থাকে কষ্টের ভেতর। তারপর সর্বনাশা জল নেমে গেলে এক সময় জেগে ওঠে মাটির মমতা; আর সেই মমতার টানে ছন্নছাড়া গৃহহারা মানুষেরা ফিরে আসে শেকড়ে। ভিন্ন কোথাও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে কিংবা পায় নি, সবাই ফিরে আসে তার বাস্তুভিটায়। কেউ কেউ চোরাস্রোতে হারিয়ে যায় মানুষ কিংবা কোনো পংকিল আবর্তে, মোহজালে আটকে থাকে দীর্ঘ সময়। তারপর একদিন সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নত হয় হৃদয় দেবতার কাছে; ভূমিপুত্র ফেরে ভূমিতে। জলগন্ধে মাটিগন্ধে আর নিজস্ব ধ্বনিতত্তে¡র অন্বয়ে গড়ে ওঠা বাঙালি কৃষকের জীবন দেশাত্ববোধের অনিরুদ্ধ আলোয় উজ্জ্বল। বাঙালি কৃষক লোভী-নোংরা ও স্বার্থপরতার অশরীরী শয়তানের ভারী জুতার তলায় থাকে না কখনো।
সহজ-সরল মাটির মানুষেরা একবার দ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠলে বিস্ফোরণ ঘটে, মহাবিস্ফোরণ। মাটি ও ফসলের ব্রতচারী এইসব মানুষের বুকের ভেতর সূর্যালোকের আলো খেলা করে। এইসব কৃষকেরাই হলো সভ্যতার প্রকৃত সন্তান; প্রকৃতির প্রত্যয় নিয়ে ক্রমাগত প্রগতির রথ তারাই টেনে নিয়ে যায় সামনের দিকে। নৃত্যের বহুবিধ মুদ্রার মতো তারা সমৃদ্ধ করে সভ্যতা ও মানুষের জীবন। বৈষম্য আর অনটনের ভেতরেও তারা ভরা ভাদরের জলোচ্ছ¡াস তুলে রাখে বুকের ভেতর একান্ত আপন গোপনে। সোনালি ফসল ফলাতে কিংবা তাদের মরুময় কষ্টের জীবনে যা বড় বেশি প্রেরণাদায়ক হয়। এইভাবে কুসুমকোরক থেকে প্রস্রবণ পর্যন্ত নিজেকে জড়িয়ে রেখে এই সব কৃষক, এই সব ভূমিপুত্র আমাদের অরণ্যপুষ্প আর রবি শস্যের গন্ধ উপহার দেয়। কৃষক জীবনের বিস্মৃতি অনুপম বোধের আলোয় আপন মনে গোলাম কিবরিয়া পিনু নান্দনিক সৌকর্যে কবিতায় উপস্থাপন করেছেন। জীবনবোধজারিত কবি সভ্যতার প্রাণ– এইসব অবহেলিত মানুষের জীবনের গভীরে তাঁর অন্তর্দৃষ্টির আলো ফেলে কবিতাকে সমৃদ্ধ করেন। যেমন :
শামুকের মত
হাঁড়ি-কলসির ভেতর না ঢুকে
দাঁড়াও মানুষ,
উঁচু দাঁত নিয়ে নয়
নীল স্পর্শ করতে আকাশস্পর্শী হও।৩৫
প্রকৃতির অসীম ভালোবাসা ও সবুজ মমতা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বদ্বীপ। এ মাটির মানুষেরা অত্যন্ত অনুভ‚তিপ্রবণ। সহজ-সরল হৃদয়বান এইসব মানুষের জীবন আজ অতিষ্ঠ করে তুলেছে চকচকে মুদ্রালোভী মানুষরূপী কিছু জন্তু-জানোয়ার। অথচ স্বাধীনতার প্রত্যয় ছিলÑ এক মানবিক সমাজ ও সোনার বাংলা গড়ার। সা¤্রাজ্যবাদের খোলা বাজারের মুৎসুদ্দি পুঁজি এক অসম প্রতিযোগিতার ভেতর ক্রমাগত গিলে খাচ্ছে সেই মানবিক মূল্যবোধ।
মানুষে-মানুষে হৃদয়ে-হৃদয়ে সবুজ সখ্যতা আজ অপসৃয়মান। মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ব লালসার পিচ্ছিলতার ভেতর হারিয়ে যেতে বসেছে। বারুদগন্ধে পালিয়ে যাওয়া পাখির মতো সুচেতনারা আজ দূরপরবাসী। এতসব অনাসৃষ্টি দেখে বিক্ষুব্ধ কবি পিনু দ্রোহের আগুন জ্বেলে মানুষের জীবনবোধ জাগ্রত করতে চেয়েছেন কবিতায়। আর সেজন্য মানবিক সমাজ গড়ার প্রত্যয় তাঁর কবিতার পরতে-পরতে অনুরণিত। সুচেতনার পনরুত্থানের জন্য কবি তাঁর কবিতায় আহ্বান জানিয়েছেন অবিরাম।
কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু কবিতার শুদ্ধ চেতনায় ঋদ্ধ মানুষ। বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে তিনি অত্যন্ত পরিচিত নাম। তাঁর কবিতার সহজবোধ্যতা পাঠককে টেনে নেয় কবিতার অন্তরজাত গভীরতার ভেতর। পাঠক সহজেই তৃপ্ত হতে পারেন রসাস্বাদনে এবং কবির চেতনার সাথে পাঠকের গড়ে ওঠে সেতুবন্ধন। কবিতার অন্বয়ে পাঠক ঋদ্ধ হতে পারেন শুদ্ধতম চেতনায়। রাজনীতি ও স্বদেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর জীবনবোধ পিনুর কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। তিনি মানুষের কাছে দায়বদ্ধ, দায়বদ্ধ মানবিকতার কাছে। তাই কবি পিনু তাঁর কবিতার অনিরুদ্ধ আলোয় শুদ্ধ করতে চান মানুষের অন্তর্লোক। সুচেতনার আলোকবর্তিকা তিনি ছড়িয়ে দেন তাঁর কবিতায়। পিনুর কবিতা এক শাণিত জীবন বোধের গান শোনায়। পিনুর কবিতার প্রগতিসড়কে বাঙালির সম্মুখযাত্রা অব্যাহত থাকুক; আর তিনি শোনাতে থাকুন–বাঙালির বিজয়ের গৌরবের গাথা।
তথ্যসূত্র :
গোলাম কিবরিয়া পিনু, ফসিলফুয়েল হয়ে জ্বলি [হুক লাগানো পেশা]
২ সূর্য পুড়ে গেল [চÐালের স্বধর্মী স্বভাব]
৩ ফসিলফুয়েল হয়ে জ্বলি [খোলা বাজারের বারভূত]
৪ তদেব, গণতন্ত্রের সুরমুর্ছনা
৫ তদেব, তুরীয়ানন্দ
৬ ফুসলানো অন্ধকার [ফুসলানো অন্ধকার]
৭ ফসিলফুয়েল হয়ে জ্বলি [সজ্জা]
৮ আমরা জোংরাখোটা [জলশক্তি]
৯ ও বৃষ্টিধারা ও বারিপাত [জলভাঙা]
১০ আমরা জোংরাখোটা [জলের সুষমা]
১ ও বৃষ্টিধারা ও বারিপাত [ঘূর্ণিজল]
২ তদেব, উদাস হাওয়া
৩ এখন সাইরেন বাজানোর সময় [ক্ষোভ নিয়ে মুখোমুখি]
৪ উদরপূর্তিতে নদীও মরে যাচ্ছে [ছদ্মবেশ]
৫ মুক্তিযুদ্ধের কবিতা [রাগতে পারছি না]
৬ তদেব, মুজিবের রক্তধারা
৭ তদেব, অধিভুক্ত হই আবারও মুক্তিযুদ্ধে
৮ তদেব, রক্তমাখা
৯ তদেব, আমাদের জন্মবার
২০ তদেব, আলোকশূন্যতা
২ তদেব, যুদ্ধ শিশু
২২ সূর্য পুড়ে গেল [যাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ]
২৩ মুক্তিযুদ্ধের কবিতা [চুরি করা শিশু মনে করে কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে]
২৪ তদেব, ইতিহাসের আগামী
২৫ তদেব, পূর্বপুরুষেরা
২৬ তদেব, মুজিবের রক্তধারা
২৭ তদেব, যুদ্ধ
২৮ সূর্য পুড়ে গেল [স্থ‚লকোণ]
২৯ আমি আমার পতাকাবাহী [আমাদের নববর্ষ]
৩০ ফসিলফুয়েল হয়ে জ্বলি [মতিহার]
৩ ও বৃষ্টিধারা ও বারিপাত [এ শ্রাবণে এ বর্ষায়]
৩২ তদেব, বরিষণমুখরিত পবনহিল্লোল
৩৩ তদেব, গর্ভকুসুম
৩৪ সুধাসমুদ্র [মুষলধারা]

সম্পর্কিত খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আবুল খায়ের 

নির্বাহী সম্পাদক: 
বার্তা প্রধান:

অফিস: বাড়ি ০৭, সড়ক ১৪/সি, সেক্টর ৪,

উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।

যোগাযোগ: ০১৭১৫৩৬৩০৭৯

বিজ্ঞাপন: ০১৮২৬৩৯৫৫৪৯

Email: khair.hrm@gmail.com

info@dainikprotibimbo.com

protibimboprokash.com

Facebook

©2025 Dainik Protibimbo – All Right Reserved. Designed and Developed by Bangla Webs