কানাডা প্রবাসী কবি ও কথাসাহিত্যিক তসলিমা হাসান’র ছোটগল্প: অর্পিতার পৃথিবী

ছোটগল্প

by protibimbo
০ মন্তব্য ৬১ বার পড়া হয়েছে

অর্পিতার পৃথিবী
তসলিমা হাসান।

অর্পিতা আমার চোখে চোখ রেখে জিগ্যেস করলো
” ছোটমা, আমার বাবা কে”?
অর্পিতা আমার বড় জা’ এর মেয়ে। বড় জা হলেও নন্দিতা আমার থেকে বছর ৩-৪ এর ছোট। আর ভাসুর যে, সে আমার থেকে ১-২ বছরের বড়। আমার হাসবেন্ড হৃদয় চৌধুরি আর ভাসুর উদয় চৌধুরি যমজ ভাই। তাদের চেহারায় যেমন মিল, স্বভাবে ঠিক ততটাই অমিল। আমার হাসবেন্ড হৃদয় প্রচন্ড চঞ্চল, সৌখিন এবং কিছুটা বোকাও। আর উদয় চৌধুরী ধীরস্থির, হিসাবি এবং বুদ্ধিমান। কিন্তু ভাইয়ে ভাইয়ে অনেক মিল মহব্বত। আমরা ঢাকা শহরে পাশাপাশি ফ্ল্যাট কিনে বহুবছর ধরে সম্পর্ক ভালো রেখে একসাথে আছি। আমার শ্বশুর মারা গেছেন কয়েকবছর হলো, শ্বাশুড়ি গ্রামের বাড়িতে থাকেন। সেখানে ওদের ঘরবাড়ি, ধানি জমি আর সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য উনি কোথাও যেতে পারেন না। বছর শেষে আমরা সবাই মিলে সেখানে গিয়ে ১৫-২০ দিন বেড়িয়ে আসি। আর উনি ঈদে কোরবানিতে আমাদের কাছে আসেন। প্রচন্ড আত্মনির্ভরশীল এবং সাহসী সৎ মহিলা আমার শ্বাশুড়ি। আমি উনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি। আমার বিয়ে হয়েছে ৩০ বছর, কোন বিপদ আপদ, সুখদুঃখ, ঝড় এসেছে কিন্তু আমি কখনো আমার শ্বাশুড়িকে ভেঙে পড়তে দেখিনি। এলোমেলো অগোছালো কথাবার্তাও সচরাচর বলেন না তিনি। অথচ গ্রামের খুব সাধারণ অল্প শিক্ষিত একজন মেয়ে উনি। আমরা সবাই কোন সমস্যায় পড়লে তার কাছ থেকে পরামর্শ নেই। এবং তিনি ধীরস্থির ভাবে চিন্তা ভাবনা করে খুব সুন্দর একটা ফয়সালাও দেন।
আমার এক ছেলে। কৌসিক। একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছে দুই বছর হলো। ভালো বেতন পায়। আগামী মাসে ওর বিয়ে। মেয়ে ওর পুর্ব পরিচিত। কিছুদিন আগে গিয়ে আমরা মেয়েটিকে আংটি পড়িয়ে বিয়ের তারিখ ঠিক করে এসেছি।
সেই বিয়ের কেনাকাটা নিয়ে বসেছিলাম আমি আর অর্পিতা। এরমধ্যেই হঠাৎ এমন প্রশ্ন আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি ও কি জানতে চাইলো! বললাম
কি?
আমার বাবা কে,ছোটমা?
এটা আবার কি প্রশ্ন, অর্পা?
বলেই আমি নতুন বৌ এর বাসায় পড়া জামাগুলো হাতে নিয়ে সুটকেসে ঢুকালাম।
কেনো, তুমি জানো না, আমার বাবা উদয় চৌধুরী না। আমি তাদের মেয়ে না।
একটা ঠান্ডা শীতল রক্ত প্রবাহ আমার পিঠের সিরধারা বেয়ে নেমে গেলো। গলাটা আটকে গেলো যেনো। আমি অন্য দিকে ফিরে নিজেকে কিছুটা ঠিক করে নিলাম। চুপ করে ভাবলাম, এবার আমি কি উত্তর দিবো, মেয়েটিকে।
অর্পার বয়স এখন ১৩ বছর। ছোটবেলা থেকে আমি ওকে কোলেপিঠে বড় করেছি নন্দিতার সাথে। অর্পা যখন ছোট তখন কৌসিক এর বয়স ১২/১৩ বছর। আমি যেহেতু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মা তাই নন্দিতা সবকিছুতেই আমার উপর ভরসা করতো বেশি। খাবারের পর ঢেকুর তুলতে নন্দিতা কোলে করে আমার কাছে নিয়ে এসে বলতো, দিদিভাই কিছুতেই ঢেকুর তুলতে পারছি না। আবার না বমি করে দেয়! আমি অর্পাকে আমার বুকের সাথে ওর ছোট পেটটাকে আলতোভাবে চেপে ধরে পিঠে দু’টো আস্তে করে থাপ্পড় দিতেই মেয়ে সুন্দর ঢেকুর তুলতো। আর নন্দিতা হেঁসে বলতো, তোমার কোলে আসবে বলেই পাজিটা এতক্ষণ চেপে ছিল ঢেকুর, দিদিভাই।

অর্পা, এসব আজগুবী প্রশ্ন বন্ধ করে যা তো, মা কি করছে দেখে আয়। কাজ শেষ হলে বল, আমি ডাকছি। লিষ্টটা ওর সাথে আরেকবার মিলিয়ে নেই। আর কি কি কেনা বাকি রইলো দেখি একবার।
ছোটমা, তুমি আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাচ্ছো তো? কিন্তু আমি কিন্তু এ প্রশ্ন এমনি এমনি করিনি। নিশ্চয়ই কারো কাছে কিছু শুনেই করেছি।
এবার কিন্তু আমার খুব রাগ হচ্ছে মেয়ে। কোথায় কি শুনছিস, বলতো? তোকে রেললাইন নাকি ডাস্টবিনের পাশ থেকে কুড়িয়ে এনেছি আমরা, হয়েছে?
না ছোটমা, আমাকে দাদিমা গ্রামের কারো কাছ থেকে এনে বাবা-মার কোলে দিয়েছে। আর বলেছে, আজ থেকে এই মেয়ে তোদের। কোনদিন কারো কাছে ওর আসল পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন নেই, এমনকি বাবা-মাও জানে না হয়ত আমার আসল বাবা-মা কে!
তাহলে তো হয়েই গেলো, আমরা জানি তুই অর্পা চৌধুরী। তোর বাবা উদয় চৌধুরী আর মা নন্দিতা চৌধুরী, ব্যস।
না ছোটমা, আমার তাতে চলবে না। আমি যেহেতু জেনেছি আমার আসল বাবা-মা এরা নয়, সেহেতু আমি আমার আসল পরিচয় জানবই।
অর্পা খুব আস্তে কিন্তু এমন দৃঢ়তার সাথে কথাগুলো বললো যে, আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেলাম।
বহুবছর আগের ঘটনা। একদিন হঠাৎ নন্দিতা এসে বললো, দিদিভাই আমি আর তোমার ভাই কাল গ্রামে যাবো। কয়েকদিন থাকবো মায়ের কাছে।
হঠাৎ! আমার শ্বশুর তখনো বেঁচে ছিলেন। ভাবলাম তারা অসুস্থ কিনা। জিগ্যেস করে জানতে পারলাম, আমার ভাসুর বেশ কিছুদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন গ্রামে গিয়ে থাকবেন বলে। উদয় চৌধুরী সবসময়ই বেশ চুপচাপ। কোন বাড়তি কথা কিংবা হাসি তামাশা করেন না বললেই চলে। আমিও আর কথা বাড়ালাম না। নন্দিতাকেও কিছুটা নিরব দেখে। আমার আর নন্দিতার বিয়ে একসাথেই হয়েছে, আজ ১৭-১৮ বছর হলো। কৌসিকের বয়স ১২ বছর। আজও নন্দিতার কোলে কেউ আসেনি। এজন্য ওরা ডাক্তার, কবিরাজ থেকে শুরু করে অনেক ওজা, হুজুর, ফকিরের কাছে গিয়েছে। কোন কাজ হয়নি। নন্দিতা এখন মনের কষ্টে নির্জীব হয়ে গেছে। কোথাও কোন দাওয়াত, অনুষ্ঠান এমনকি নিজের বাপের বাড়িও যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে বেচারা ঘরে নিজেকে বন্দী করেছে কয়েক বছর হলো। তাই গ্রামে গিয়ে কয়েকদিন বেড়াবে শুনে আমি খুব খুশি হলাম।
যা বোন, বেড়িয়ে আয়, মনটা ভালোলাগবে।

তসলিমা হাসান ।
টরেন্টো
১৬/৪/২৫

banner

সম্পর্কিত খবর

সম্পাদক: আবুল খায়ের (কবি ও কলামিস্ট)।
নির্বাহী সম্পাদক:
বার্তা প্রধান:

অফিস:  বাড়ি ১১, সড়ক ৩, সেক্টর ৬,  উত্তরা, ঢাকা-১২৩০।
যোগাযোগ: ০১৭১৫৩৬৩০৭৯
বিজ্ঞাপন: ০১৮২৬৩৯৫৫৪৯
Email: info@dainikprotibimbo.com khair.hrm@gmail.com

Facebook

©2025 Dainik Protibimbo – All Right Reserved. Designed and Developed by Bangla Webs