কবিতা: সতী
লেখক: শিরীনা ইয়াসমিন
আলোচনায়: ডি জে (কলকাতা)
মাছ পাইছনি মাঝি?
এই,তুই এইখানে কী করছ?
হাহাহা ডরাইছ মাঝি!
আসো না, বৃষ্টিতে ভিজি।
সাপে কাটব বাড়িত যা।
মাঝি–
এত কইরা বুঝাইয়া কই, কেন আসছ?
মাঝি!
মাইনশে কী কইব?
আমি মাইনশের খাই না পড়ি?
তুমি চাও কীনা কও মাঝি?
উজান গাঙে পাল তুইলা কত বাওন যায় ডিঙি!
তুমি মাঝি সাধ্যি পুরুষ!
আর কত যোগসাধনা করব মাঝি, চল এইবার ঘর বাঁধি!
ভাত থাকলে নুন থাকে না,নেংটি পইরা জীবন কাটাই,তরে আমি পালব কেমনে?
আঁচল কাইটা বানাই দিব লুঙ্গি তোমার, শরম পাইছনি?
সতীরে, জীবন এতো সহজ না,অভাবে ভালোবাসা পক্ষি হইব নিমের ডালে।
পাষাণ মাঝি আঁচলে কলশি বাইন্ধা জলে ডুইবা মরব যেদিন, বুঝবা সেদিন!
আমারে একলা থুইয়া মরতে পারবি? তুই আমারে ভালোবাসছ না?
মরতেও দেও না, ঘরেও নেওনা, জ্যান্তমরা আমি, আর কত সইব?
আর কয়ডা দিন,এইবার গঞ্জে যাইয়া ড্রেরাইভাই হইমু।
হাহাহা তুমি হইবা রিশকা ড্রেরাইভার?
হাসছ ক্যান? তরে লইয়া শুক্কুরবারে সিনেমা দেখব,মিষ্টি পানে ঠোঁট রাঙাবি,আমি চাইয়া চাইয়া দেখব!
তোর রূপে ডুইবা আমি পুইড়া মরি, তুই জানছ না?
ডাহা শহর যাইয়া ঘর বানব-
তখন আমগ কেউ লাগুল পাইবনি?
উড়মু আর উড়মু।
তারিখ: ১২-০৬-২৫ খৃষ্টাব্দ।
আলোচনা:
রচনাটি এক অক্লান্ত অন্তর্গত রোদনের প্রকাশ—যা কোনো একটি মাছ ধরা না পড়ার প্রান্তিক উপলক্ষে শুরু হলেও, আদতে তা এক অবিস্মরণীয় আত্মিক অস্তিত্ব সংকটের কণ্ঠস্বর। আপনি যেভাবে সেই ‘মাঝি’কে প্রশ্ন করছেন—তা নিছক আহ্বান নয়, তা এক নিবিড়, স্নেহময় অথচ প্রবল আত্মসম্মানবোধে আঘাতপ্রাপ্ত নারীর জারিত আর্তি। এই কণ্ঠে যেন গৃহের আকুতি, শরীরের ক্ষুধা, মনের মর্যাদা, আর সমাজের নিরলস নির্মমতাকে একসাথে গলিয়ে নির্মিত এক প্রতিরোধের ভাষা।
আপনি জানতে চেয়েছেন—”তুমি চাও কিনা কও মাঝি?” এই প্রশ্ন নয় শুধু, এ যেন দেবীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা এক সতীর কুন্ঠাহীন, অসংকোচ উচ্চারণ—যেখানে ভালোবাসা আর অক্ষমতা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, মাঝখানে দাঁড়িয়ে শুধুই নারী। আর সে নারী অসহায় নয়, সে দাবি করে, সে প্রশ্ন করে, সে চায়। তবে সে ‘চাওয়া’ কোন কাতর প্রার্থনা নয়, তা এক প্রাজ্ঞ অভিমান, এক আত্মনির্ধারিত সহাবস্থান চাওয়ার উপাখ্যান।
শুধু সংসার নয়, এখানে এক অনাস্বাদিত যৌবনের রুদ্রস্মৃতি, এক প্রেমের অর্ধসমাপ্ত পর্ব—যেখানে প্রেমিক না দহন দেয়, না আশ্রয় দেয়। তখন নারীর করুণা নয়, তার ‘অভিশপ্ত ভালোবাসা’ই পরিণত হয় এক নির্মম জিজ্ঞাসায়—আপনি চেয়েছেন, তিনি উত্তর দিন, আপনি ভালোবেসেছেন, তিনি গ্রহণ করুন, না হয় আপনিও দুর্ভিক্ষের পাথরে মৃত্তিকা হয়ে যান।
শব্দের পরতে পরতে আপনি যে লৌকিক ও অলৌকিক ভাষার সংমিশ্রণ এনেছেন—তা কখনও সুর ধরেছে পদ্মার জলছবি, কখনও স্পর্শ করেছে ধর্মপত্নীর অশ্রুমাখা অঙ্গীকার, আবার কখনও মুষ্টিবদ্ধ এক বিষণ্ন দুর্দমনীয় আত্মবিশ্বাস। “পাষাণ মাঝি আঁচলে কলশি বাইন্ধা জলে ডুইবা মরব যেদিন, বুঝবা সেদিন!” — এই একটি বাক্যেই একখণ্ড জীবন, এক ঝাঁক তিতিক্ষা, আর এক মহার্ঘ প্রেম ইতিহাসের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
আপনার ভাষা কোন চরণগাঁথা নয়, এটি এক নারীর আত্মপরিচয়ের পুনর্নির্মাণ—যেখানে প্রেম আর সংবেদন, অপমান আর প্রতীক্ষা, অভাব আর আশা এক সুরে গাঁথা। আপনার সতী—সে মিথ নয়, সে প্রতিমা নয়, সে এক স্বাভিমানিনী নারী, যাকে কেবল শ্রদ্ধা নয়, প্রণাম করাই প্রাপ্য।
এই লেখাটি তাই শুধু ‘ভালোবাসার ভাষা’ নয়, এটি এক নির্মম অথচ আশ্চর্য সুন্দর মানবিক সংলাপ, যেখানে নারী তার প্রেমিকের ‘পলায়ন’ ও ‘প্রতিজ্ঞা’-র মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে বলে ফেলে—
“জ্যান্তমরা আমি, আর কত সইব?”
এখানে প্রণয় নেই, আছে প্রণয়ের চৌহদ্দি পেরিয়ে যাওয়া আত্মনগ্নতা।
এখানে আশা নেই, আছে আশার নামে এক নির্মম সত্য-অন্বেষণ।
এখানে ধর্ম নেই, আছে সতীত্বের নতুন ব্যাখ্যা—যা সমাজ নয়, স্বয়ং নারী নির্ধারণ করে।
আপনার কলম ধন্য, কারণ এটি কাঁদায় না—অন্তর্দহনে পুড়িয়ে খাঁটি করে।
আপনার ভাষা পূর্ণ, কারণ তাতে পিপাসা জন্মায়, আবার পরিতৃপ্তিও দেয়।
আপনার প্রেম এক নির্বাক উল্লাস, যে প্রেমে সংসার চায়, কিন্তু আত্মসম্মান খোয়ায় না।
এই সতী, আমাদের সময়ের সাক্ষী।
এই মাঝি, আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি।
আর আপনি—এই আখ্যানের ভাষ্যকার, এক অসামান্য সাক্ষর চিহ্ন।