উন্নয়ন কর্মী নিয়োগের সেকাল একাল
মোঃ নজরুল ইসলাম
বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ সু-অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য বেসরকারি সংস্থার
ভূমিকা অপরিসীম, যা স্বাধীনতা পরবর্তীতে শুরু হয়ে আজও বিদ্যমান আছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এনজিও সেক্টরে কাজের ধরণ ও কর্মী নিয়োগের পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে ।
১৯৭২-১৯৯০: আদর্শবাদী ও স্থানীয়ভিত্তিক নিয়োগ
সময়ে স্বীকৃতিহীন এ সেক্টরে কর্মীর আগ্রহ তৈরী করা ছিল সংস্থা গুলোর বড় চ্যালেঞ্জ। এই সময়ের এনজিও কর্মীরা ছিলেন সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত, যারা সীমিত সম্পদে বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম ছিলেন। প্রায় সম্পূর্ণ বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরশীল সংস্থা গুলো দক্ষ কর্মীর অভাব অনুভব করতো ফলে কর্মী উন্নয়নে ব্যাপক মনোনিবেশ করতে অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হতেন। তখন বাংলাদেশে এনজিও কর্মী নিয়োগের পদ্ধতি ছিল অনেকটাই আদর্শবাদী, স্থানীয়ভিত্তিক এবং অনানুষ্ঠানিক। এই সময়টিতে এনজিওগুলো মূলত যুদ্ধোত্তর পুনর্বাসন, দারিদ্র্য বিমোচন, এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে নিয়োজিত ছিল। এনজিওগুলো সাধারণত স্থানীয় জনগণের মধ্য থেকে কর্মী নিয়োগ করত, যারা এলাকার বাস্তবতা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত ছিলেন। স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক প্রেক্ষাপট বোঝার ক্ষমতা ছিল নিয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা।অনেক কর্মী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ শুরু করতেন, পরে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্থায়ী নিয়োগ পেতেন। সমাজসেবার প্রতি আগ্রহ ও মানবিক মূল্যবোধ ছিল প্রধান নিয়োগযোগ্যতা।উচ্চশিক্ষার চেয়ে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা ও উৎসাহ বেশি গুরুত্ব পেত। অনেক কর্মী ছিলেন মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পাশ, কিন্তু সমাজে কাজ করার দক্ষতা ছিল বেশি। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মানব সম্পদ বিভাগের উপস্থিতি ততটা সরব ছিলনা বরং পরিচিতি, সুপারিশ, এবং পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিয়োগ হতো। কিছু এনজিও বিদেশি দাতাদের সহায়তায় পরিচালিত হতো, ফলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী নিয়োগের চেষ্টা করা হতো।এই সময় নারী কর্মীর সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে কম, বিশেষ করে মাঠ পর্যায়ে। তাই অনেক সংস্থার পক্ষ থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নারীদের চাকুরীতে যোগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হতো।
১৯৯১-২০১০ : পেশাদারিত্বের গুরুত্ব
সময়কালটি ছিল এনজিও নিয়োগ ব্যবস্থার পেশাদারীকরণের সূচনা। বিশেষ করে বড় এনজিও গুলো এই সময়টিতে আরও প্রাতিষ্ঠানিক, পেশাদার এবং কাঠামোবদ্ধ নিয়োগ প্রক্রিয়া গ্রহণ করে। তখন থেকে বড় এনজিওগুলোতে মানব সম্পদ বিভাগ গঠিত হয়, যা নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন ও বেতন কাঠামো পরিচালনা করে। নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক সাক্ষাৎকার, এবং ক্ষেত্রভিত্তিক মূল্যায়ন চালু হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠে।উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকা আবশ্যক হয়ে ওঠে, বিশেষ করে প্রশাসনিক ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা পদে। কর্মীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়, মেয়াদ নির্ধারিত থাকত প্রকল্পের সময়সীমা অনুযায়ী।নতুন কর্মীদের জন্য ছয় মাস থেকে ১ বছর প্রবেশন পিরিয়ড চালু হয়। নিয়োগে নারী, আদিবাসী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া শুরু হয়, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির অংশ ছিল। কর্মীদের জন্য বেসিক বেতন, মেডিকেল সুবিধা, অর্জিত ছুটি, প্রশিক্ষণ সুযোগ ইত্যাদি চালু হয়।
তবে অনেক ছোট ও মাঝারি এনজিও এই সুবিধা দিতে পারত না এবং তারা বড় এনজিওর নীতিমালা অনুসরণ করত। এই সময় প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত ছিল, তবে কম্পিউটার ভিত্তিক ডেটা ম্যানেজমেন্ট ব্যাপক আকারে শুরু হয়।
২০১১ থেকে ২০২৫: প্রযুক্তি ও অধিকতর দক্ষতা নিৰ্ভর
এই সময়কালে এনজিও নিয়োগ ব্যবস্থায় এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। আন্তর্জাতিক মান, অন্তর্ভুক্তি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।বড় এনজিওগুলোতে মানব সম্পদ বিভাগ সক্রিয়ভাবে প্রযুক্তি নিৰ্ভর নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। শুরু হয় মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা অনুযায়ী নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, মূল্যায়ন ও পদোন্নতি । নিয়োগের কয়েকটি স্তর অতিক্রম করেই একজন কাঙ্খিত কর্মীকে নিয়োগ দিতে সক্ষম হয়। যেমন; চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ (অনলাইন ও পত্রিকায়), আবেদন যাচাই ও সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি, লিখিত পরীক্ষা ও সাক্ষাৎকার, প্রবেশন পিরিয়ড (তিন মাস থেকে ১ বছর),চুক্তিভিত্তিক ও স্থায়ী নিয়োগ। শুরু হয় অন্তর্ভুক্তিমূলক নিয়োগ নীতি যেমন নারী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও ট্রাই জেন্ডার ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে এ সেক্টরটি বিশেষ স্থান দখল করে নেয়া ও দেশে বেকারত্বের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাওয়ায় প্রতি পদের বিপরীতে অনেক সংখ্যক আবেদন জমা পরে। ফলে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি দক্ষতার আবশ্যকতার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।
যেমন ; স্নাতক/স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আবশ্যক, বিশেষ করে , কৃষি, পুষ্টি, জনস্বাস্থ্য, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি এবং বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় ডিজিটাল দক্ষতাকে। বেতন ও অন্যান্য সুবিধা নির্ধারিত হয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী।
শুরুর দিকে এনজিও সমূহে বহিরাগত অর্থ সরবরাহ থাকলেও ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। বর্তমানে এ সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে এক সময় এনজিও সেক্টরে কর্মী নিয়োগের পর কর্মীকে সংস্থার উপযোগী করে তোলার জন্য প্রশিক্ষন ও বিনিয়োগ করা হতো কিন্তু বর্তমানে সে সুযোগ খুব কম তাই তারা দক্ষ কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন এ সেক্টরে কর্মীদের নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে তুলছে। দাতা সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী প্রতি নিয়ত প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। চাকুরীতে অভিজ্ঞতার পাশাপাশি নতুন পরিস্থিথিতে খাপ খাওয়ানোর স্বক্ষমতাও এখন অবশ্যাম্ভাবী হয়ে পড়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এনজিও সেক্টরে নতুন যোগদানকারীদের জন্য যেমন চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তেমনি পুরাতনদের জন্য টিকে থাকাও কঠিন হয়ে উঠেছে। তবে আশার কথা হলো—দাতা সংস্থার তহবিল হ্রাস পাওয়ার পরও দেশীয় সংস্থাগুলো টিকে থাকার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। মানুষের জন্য ও মানুষের সাথে কাজ করার ইচ্ছাশক্তি সম্পন্ন তরুণ ও অভিজ্ঞ জনের এখনো এই সেক্টরে নিজেদের উপযুক্ত করে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।