আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই।
দেলওয়ার এলাহী
জীবনে কিছু মুহূর্ত আসে, যা স্মৃতির মণিকোঠার বৈয়মে জমিয়ে রাখে মানুষ। ‘জমিয়ে রাখে’ কথাটা আসলে ভুল বললাম৷ সচেতনভাবে তো আর মানুষ স্মৃতি ধরে রাখেন না। স্মৃতির পর্দায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু মুহূর্তের ছবি জমা হয়েই থাকে। আজকের সন্ধ্যাটি সেরকম। অন্তত আমার কাছে তো বটেই। আমার ধারণা আজ যারা টরন্টোর ৮তম বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যালের অনুষ্ঠানে সাবিনা ইয়াসমিনের গান শুনেছেন, তাদের অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন।
বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যালের মূল স্বপ্নদ্রষ্টা ও সফল আয়োজক শহিদুল ইসলাম মিন্টু প্রায় ছয় মাস আগে বলেছিলেন এবারের আসরের মূল শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। ইতোমধ্যে শিল্পীর শরীর অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় আমার আশংকা হয়েছিল, তিনি হয়তো এবারের আসরে আসতে পারবেন না। কিন্তু মিন্টু বরাবরই বলেছেন শিল্পী সুস্থ হলে ফেস্টিভালে আসবেন।
যেহেতু এই শিল্পীর নাম সাবিনা ইয়াসমিন, বাংলাদেশের গানের জগতে ‘ট্রু লিজেন্ড’, তাই অসুস্থতা কাটিয়ে আসরে উপস্থিত হলেই আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। যে কোন কিংবদন্তিকে সামনাসামনি দেখাও তো এক অভিজ্ঞতার সঞ্চয়! যে সুমধুর কোকিল কণ্ঠের গান শুনে আমরা বড় হয়েছি এবং গানকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশকে আরো বেশী করে ভালোবাসতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি, অসুস্থতার কারণে সেই জোরালো কণ্ঠে গান গাইতে না পারলেও তিনি যেহেতু সাবিনা ইয়াসমিন, আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশে কোনরকম কমতি হবে না।
আমার এই অমূলক ধারণা ও আশংকা আজ ভুল প্রমাণিত করে প্রিয় শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন যেন আজ আরো মধুর সুরে আরো প্রাণ উচাটন করা আবেগে আমাদের সবাইকে ভাসিয়ে দিলেন। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মালিক প্রকৃতির মহাশক্তিধর কারিগর সৃষ্টিকর্তা মহামহিম যেন কিছু বিশেষ মানুষকে তার বিশেষ দানে ও গুণে এমন আশ্চর্য যাদু দিয়ে সৃষ্টি করেন, যে প্রায়শই আমরা এই যাদুর মুখোমুখি হয়ে বিহ্বলিত হয়ে তাকিয়ে দেখি। মুগ্ধতায় আবেশিত হই। উপর্যুক্ত বিশেষণের অভাবে নির্বাক হয়ে থাকি। নির্বিকার হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় থাকে না। আজ বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যালে আমাদের সবার প্রিয় শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন আমাদেরকে আশ্চর্য সুন্দর কণ্ঠে গান শুনিয়ে শুধু মুগ্ধই করলেন না; স্মরণে রাখার মতো একটা শিক্ষাও দিয়ে গেলেন; প্রকৃত শিল্পীর প্রধানতম অলংকারই তার বিনয় ও অতীতের গুণীদের শিক্ষায় ও সান্নিধ্যে যে আজ পরিপূর্ণতা, তা অকপটে শ্রদ্ধা ও সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করা। বড় শিল্পীর মুখোমুখি হলে তাই আমরা শুধুই যে তাদের শিল্প গ্রহণে তৃপ্ত হই, তাই নয়, হেঁটে আসা দূর পথে বটবৃক্ষের ছায়াসুশীতল মুহূর্তগুলোকেও কীভাবে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করে প্রকাশ করতে হয়, এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও হই।
আজকে বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল-এ সাবিনা ইয়াসমিন যেন ঝলসে ওঠেছিলেন তাঁর অসাধারণ শক্তিমত্তাময় মধুর কণ্ঠের গানে গানে।
যে কোন গানের আসরে আমি ব্যক্তিগতভাবে যা আশা করি এবং প্রায়শই আহত হই, শিল্পীর কণ্ঠে গান গাইবার আগে, প্রতিটি গানের গীতিকার ও সুরকারের নাম বলা, আজ সাবিনা ইয়াসমিন প্রতিটি গানের আগে গীতিকার ও সুরকারের নাম অতি সম্মানের সঙ্গে শুধু স্মরণই করলেন না, তাঁদের অবদানে যে আমাদের দেশের গান সমৃদ্ধতর হয়েছে সেকথাও আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। কানায় কানায় হলভর্তি দর্শক-শ্রোতাদের সামনে একজন সাবিনা ইয়াসমিন যখন বলেন যে, তিনি কত ভাগ্যবান যে, আমাদের দেশের কত মহান মহান গীতিকার ও সুরকারের গান তিনি গাইতে পেরেছেন! একটু গভীরভাবে ভাবলেই এতে বুঝা যায় যে, আমাদের দেশে কত মহান গীতিকার ও সুরকার বাংলাদেশের গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন। আর তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই অতি নির্ভরশীল ও শিল্পী ছিলেন এবং আজও আছেন সাবিনা ইয়াসমিন। হ্যাটস অফ আমার প্রিয় ভাই শহিদুল ইসলাম মিন্টুকে। অবিরাম অবিরাম অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা সংস্কৃতিবান্ধব টরন্টোবাসীকে। শহিদুল ইসলাম মিন্টুর উদ্যোগ, সাহস, পরিকল্পনা ও সফলযাত্রার সহযাত্রী হয়ে এভাবে পাশে থাকলে আপনারা এই শহরের সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রাকে আরো আরো বহুদূরে নিয়ে যাবেন, এই বিশ্বাস আমাদের সবার। শহিদুল ইসলাম মিন্টু টরন্টো তথা কানাডার বাংলাদেশী কমিউনিটিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন তার বহুবিধ কাজের সফল উদ্যোগে। শহিদুল ইসলাম মিন্টু ও বাংলাদেশ ফেস্টিভ্যাল সংশ্লিষ্ট সবাইকে আবারও আমার অভিনন্দন ও ভালোবাসা।
গীতিকার মাসুদ করিম যেন সাবিনা ইয়াসমিনের শিল্পী জীবনের কথাই তাঁর লেখা গানের কবিতায় লিখে রেখেছেন – আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো / গন্ধ বিলিয়ে যাই….! সত্যি সত্যি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন সুরের মৌতাত বিলিয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের গান পিয়াসী কানের কাছে। আজ রাতের এই কণ্ঠের অনুরণন আমাকে এখনো মোহমুগ্ধ করে রেখেছে! আহা!
জয়তু সাবিন ইয়াসমিন! আরো আরো অনেকবার আমাদের শহরে আপনার পদচ্ছাপে ধন্য হোক৷ ধন্য হোক আপনার কণ্ঠ সুধায় আমাদের কান!
দেলওয়ার এলাহী
মে ১৮, ২০২৫
টরন্টো