বাংলাদেশ একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে কৃষি, শিল্প এবং আবাসন খাতে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটছে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কলকারখানা, হাসপাতাল, খাদ্যগুদাম, হোটেল এবং আবাসিক ভবনের সংখ্যা। এসব স্থানে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সম্পদের নিরাপত্তার জন্য কীটপতঙ্গ দমন বা পেস্ট কন্ট্রোল একটি অপরিহার্য সেবা। যদিও এই খাতে দক্ষ জনবলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, তবুও দেশে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অভাবে দক্ষ টেকনিশিয়ান তৈরি হচ্ছে না। এর ফলে একদিকে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে, অন্যদিকে ঘটছে অর্থনৈতিক ক্ষতি।
কেন দক্ষ জনবল অপরিহার্য? পেস্ট কন্ট্রোলকে অনেকেই একটি সাধারণ কাজ মনে করলেও, এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং কারিগরি জ্ঞান-নির্ভর একটি পেশা। সঠিক কীটনাশক নির্বাচন, প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ এবং নিরাপত্তার নিয়মাবলী মেনে চলা এর জন্য অপরিহার্য। পেস্ট কন্ট্রোল খাতে দক্ষ জনবল কেন জরুরি, তা কয়েকটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়:
শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ: গার্মেন্টস শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা, ঔষধ ফ্যাক্টরি এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানে পণ্যের মান বজায় রাখতে নিয়মিত পেস্ট কন্ট্রোল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক মান রক্ষায় বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা অর্জনের জন্যও এই কার্যক্রম অপরিহার্য। বর্তমানে প্রায় ১৫০টিরও বেশি লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান এই সেবা দিচ্ছে, পাশাপাশি আরও ৫০০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ছাড়াই কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৭,৫০০ দক্ষ টেকনিশিয়ানের চাহিদা রয়েছে। অথচ, অদক্ষ জনবল অনেক সময় ভুল কীটনাশক প্রয়োগ করে পণ্যের মান নষ্ট করছে কিংবা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
জনস্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা: হাসপাতাল, রেস্তোরাঁ, আবাসিক হোটেল এবং বাসাবাড়িতে কীটপতঙ্গের উপদ্রব জনস্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি। ইঁদুর, তেলাপোকা, মশা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ নানা ধরনের রোগ ছড়ায়। অন্যদিকে, পেস্ট কন্ট্রোলের সময় রাসায়নিক পদার্থ সঠিকভাবে ব্যবহার না হলে তা মানুষের জীবনকেও বিপন্ন করে তোলে। অদক্ষ টেকনিশিয়ানের কারণে বিষক্রিয়া, অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট কিংবা মৃত্যুর মতো দুর্ঘটনা ঘটছে। এর ভয়াবহ উদাহরণ হলো ২০২৩ সালের ৫ জুন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় কীটনাশক প্রয়োগের পর দুই শিশুর মৃত্যু। একই ভাবে, ২০২৫ সালের ৪ জুন ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে ছারপোকা দমনের ওষুধে বিষক্রিয়ায় ঘুমন্ত অবস্থায় দুই শ্রমিক মারা যান।
সরকারি ও বেসরকারি খাতে চাহিদা: দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মশক দমন কর্মসূচি, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিভিন্ন সরকারি দফতর, বিমানবন্দর, পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং অসংখ্য সরকারি ভবনে নিয়মিত পেস্ট কন্ট্রোল কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসব খাতে হাজার হাজার দক্ষ টেকনিশিয়ানের চাহিদা রয়েছে। একই ভাবে, প্রায় এক হাজারেরও বেশি শিল্পগোষ্ঠী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পেস্ট কন্ট্রোল পরিচালনা করছে, যেখানে প্রায় ১৫,০০০ টেকনিশিয়ানের প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক বাজারে কর্মসংস্থানের সুযোগ: মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উন্নত দেশগুলোতে দক্ষ পেস্ট কন্ট্রোল টেকনিশিয়ানের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ শ্রমশক্তি বিদেশে রপ্তানি হলেও প্রশিক্ষণের অভাবে এই বিশেষ খাতে জনবল পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। একটি সুসংগঠিত ও আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা তৈরি করা গেলে এ খাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা: উপরোক্ত সমস্যাগুলোর সমাধানে বাংলাদেশে একটি সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে আধুনিক পেস্ট কন্ট্রোল টেকনিশিয়ান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য। এই কেন্দ্র কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে অথবা লাইসেন্সপ্রাপ্ত পেস্ট কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় পরিচালিত হতে পারে। এখানে কীটতত্ত্ববিদ (Entomologist) ও কৃষিবিদদের (Agriculturist) নেতৃত্বে পাঠ্যক্রম তৈরি ও বাস্তবায়ন করা উচিত।
প্রশিক্ষণের বিষয়বস্তু হতে পারে:
- কীটপতঙ্গ শনাক্তকরণ: মশা, তেলাপোকা, ইঁদুর, উইপোকা, সাপ প্রভৃতির জীবনচক্র, আচরণ ও ক্ষতির ধরন।
- কীটনাশকের প্রকারভেদ: কীটনাশকের রাসায়নিক গঠন, কার্যকারিতা ও পরিবেশগত প্রভাব।
- নিরাপত্তা ও সুরক্ষা: কীটনাশক প্রয়োগের সময় PPE (Personal Protective Equipment) ব্যবহারের নিয়মাবলী এবং জরুরি পরিস্থিতিতে করণীয়।
- আধুনিক কৌশল: ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট ম্যানেজমেন্ট (IPM) এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি।
- আইন ও নীতিমালা: স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও বিধিনিষেধ সম্পর্কে ধারণা।
পেস্ট কন্ট্রোল টেকনিশিয়ান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শুধুমাত্র দক্ষ জনবলই তৈরি করবে না, বরং এই খাতে একটি মানসম্পন্ন পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করবে। এর ফলে অদক্ষতার কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনা কমে আসবে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও গতিশীল হবে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির নতুন দিগন্ত উন্মোচন হবে।
অতএব, সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং বেসরকারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে একটি আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা জাতীয় অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য।
মোঃ মাহমুদূল হাসান সোহেল সহকারী অধ্যাপক এন্টোমোলজি বিভাগ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা-১২০৭